মস্তিষ্ক কীভাবে কল্পনা করে? মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর কি কল্পনা করার ক্ষমতা আছে?

মস্তিষ্ক কীভাবে কল্পনা করে? মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর কি কল্পনা করার ক্ষমতা আছে?

মস্তিষ্ক কীভাবে কল্পনা করে?

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এর মতে, " কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কারন জ্ঞানের সীমা আছে, কিন্তু কল্পনারা সীমাহীন। "


চিত্র, মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সংযোগ।

কল্পনা হলো মস্তিষ্কে মনের ভেতর সৃজনশীল প্রতিচ্ছবি তৈরি করার ক্ষমতা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বাইরে মন থেকে কিছু অনুভব ও চিত্রায়ন করা হলো কল্পনা। কোন সমস্যার সমাধানে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োগ কল্পনাকে সাহায্য করে। বলতে পারেন কল্পনায় অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে একীভূত করে কোন কাজের সমাধান পেতে চায় মানুষের মন। কল্পনা থেকেই মানুষ তার বিভিন্ন পরিকল্পনার সূত্র খোঁজ করে থাকে।

মানুষের মস্তিষ্ক বর্তমান অবস্থায় এসেছে মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছরের বিবর্তনে। প্রতি মুহূর্তে মস্তিষ্কের ১০০ বিলিয়ন স্নায়ুর সংযোগের ফলে আমরা দৈনন্দিন সিদ্ধান্তগুলো নিই। এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বাইরে মস্তিষ্কে মনের যে বিশাল কর্ম পরিসর তার ঐচ্ছিক স্বচিত্রায়ন যুক্ত অনুভূতি কল্পনার জন্ম দেয়।

ওই সমস্ত ভাগ্যবান প্রজাতির একটি হলো মানুষ যাদের মস্তিষ্কের তিনটি lobe সম্পূর্ণ পৃথক নয় ও তিনটি lobe এর মধ্যবর্তী স্থানে ট্রাফিকের ন্যায় অসংখ্য স্নায়ূর সংযোগ আছে।

কল্পনার প্রভাবক সমুহ

কল্পনার তিনটি প্রভাবক আছে:

  • আমাদের পরিবেশ,
  • আমাদের স্মৃতিগুলো ও
  • পৃথিবীর সহজাত নিয়মাবলি যতটুকু আমরা জানি।

কল্পনা ধরন:

কল্পনা দু ধরনের:

অনৈচ্ছিক কল্পনা: ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা বা দিবাস্বপ্ন।

ঐচ্ছিক কল্পনা: উৎপাদনশীল কল্পনা বা সৃজনশীল চিন্তা, যেটা পরিপ্রেক্ষিত ঘটনাগুলোর স্বপ্ন।

কল্পনা মনের ভেতরে কিভাবে কাজ করে:


চিত্র, fMRI মেশিনে কল্পনার সময় মস্তিষ্কের উদ্দীপিত অঞ্চলের ছবি।

কল্পনা বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেকোন বিষয় তুলে নিয়ে জটিল ইফ-ফাংশন এর মাধ্যমে নতুন নিজস্ব ধারণা প্রকাশ করে। মনের নতুন উন্নয়নের চাবিকাঠি এটা। সম্ভাবনা আছে এমন চিন্তার কারনেই কল্পনার জন্ম হয়।

কল্পনা, মানুষের বাহ্যিক সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির উপায়।

এই ধারনার সাথে সংগতিপূর্ণভাবে দেখা যায় কাল্পনিক সুখের ও কষ্টের ঘটনা আবেগের সাথে একত্রিত হয়ে মানসিক উপলব্ধি তৈরি করে।

এক্ষেত্রে ব্রেনের fMRI (functional magnetic resonance imaging of brain) মেশিনের উদ্ভাবন এই কাজে বেশ সহায়তা করে। এর সাহায্যে মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহের গতি বোঝা যায়। সাধারণত স্নায়ুর গতিবেগ বৃদ্ধির সাথে মস্তিষ্কের রক্তের গতিবেগ বাড়ে। এর ফলে কল্পনার সময় মস্তিষ্কের কোন অংশগুলো সক্রিয় হয় তার রূপরেখা পাওয়া যায়।

মস্তিষ্ক কিভাবে কল্পনা করে:

কল্পনার সময়ে মাথার ভেতরে কি হয় সেটা জানার চেষ্টা আজো অবধি বিজ্ঞানীরা করে চলেছেন।

কল্পনার সময় স্নায়ুর সংকেত সমূহ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে যা একটি ঐতিহাসিক আবিষ্কার। মস্তিষ্কের কোথায় ভাষা , কোথায় দৃশ্য আর স্মৃতি তৈরি হয় সেসব আবিষ্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি।

মস্তিষ্কের প্রতিটি স্থানের কর্মক্ষেত্র আলাদা। কোন বিশেষ কাজের জন্য তার নিজস্ব স্থান আছে।মস্তিষ্কের ভেতরে মনকে নিয়ন্ত্রণকারি স্নায়ুকোষ গুলোর উদ্দীপনায় আমরা কল্পনা প্রবন হই।

আমাদের মস্তিষ্কের default নেটওয়ার্ক হলো সৃজনশীলতা ও কল্পনা। শরীর বিশ্রাম পেলে সেটা আমাদের সেই জগতে নিয়ে যায়। সচেতন বা এক্সিকিউটিভ নেটওয়ার্ক হলো বাস্তবতা । মস্তিষ্ক যখন বাস্তব কাজে নিয়োজিত থাকেনা তখন সে আবার ডিফল্ট নেটওয়ার্ক এ চলে আসে। সেটাই কল্পনার ও দিবাস্বপ্ন এর কারণ।

দিবাস্বপ্ন দেখার জন্য উপযোগী বিষয়গুলো হলো আচরণ ও সামাজিক অবস্থান। মনের গভীরে নিজ অভিজ্ঞতায় মস্তিষ্ক এর স্নায়ুগুলো পরস্পর সংযোগ করে। এসময় শরীর অন্য কোন কাজ বা চিন্তা করতে পারেনা।

দিবাস্বপ্ন এর সময় অন্য কোন চিন্তা কাজ করেনা। চিন্তারা স্রোতের মত আসতে থাকে । এবং এটিই কল্পনার স্তর।

আমাদের frontal lobe বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করে ও কল্পনার সময় সেগুলো parietal lobe এর সাথে ঐচ্ছিকভাবে সংযোগ স্থাপন করে। এক্সিকিউটিভ সচেতন নেটওয়ার্ক ও ডিফল্ট নেটওয়ার্ক একটি ওপরটির বিপরীত এবং পরস্পর দমনশীল।

এক্সিকিউটিভ নেটওয়ার্ক এর ঐচ্ছিক সতর্কতার ফলে মনের গভীরে যেমন তেমনি বহির্বিশ্বের বাইরেও যাওয়া যায়। মনের কর্মক্ষেত্র থেকে কল্পনায় ভবিষ্যত কেমন হবে তাও দেখা যেতে পারে। এটা থেকেই সায়েন্স ফিকশন এর জন্ম হয়।

ভবিষ্যতে মানুষের কর্মকান্ড ও ব্যবসা বোঝার জন্য ও কল্পনা সাহায্য করতে পারে।

বাস্তবতা ও কল্পনার পার্থক্য:


চিত্র, কল্পনার ভেতর বিভিন্ন ঘটনার প্রতিচ্ছবি ভাঙচুর করে , নতুন সৃজনশীল একাধিক বিষয়ের সৃষ্টি।

বাস্তব জীবনে মস্তিষ্কের কাজ একরকম কিন্তু কল্পনার জীবনে সে অন্য। বাস্তবের পৃথিবী অনেক জটিল, পরিস্থিতি আপনার অনুকূল থাকেনা সবসময়। কিন্তু কল্পনার জগতে গিয়ে সেটাকে একই ছাচে ফেলে সমাধান খুঁজে মানুষ।

কল্পনা সৃষ্টির জন্য মস্তিষ্কের অনেক অংশকে একীভূত হতে হয়। সেজন্য মস্তিষ্ক কম্পিউটার এর মতই কাজ করে। তবে এটি আরো জটিল ও বড় ক্ষেত্র।

বাস্তব জগতের দৃশ্যমান ঘটনা মস্তিষ্কের occipital lobe থেকে parietal lobe এর দিকে যায় কিন্তু কল্পনা উল্টাপথে চলে।

Occipital lobe মগজের পেছনে থাকে , যাতে চোখ দিয়ে দৃশ্যধারণ হয় ও যার মূল কাজ দৃশ্যমান খবর সংগ্ৰহ করা। এর উপরে থাকে parietal lobe যার মূল কাজ দৃশ্য, শব্দ ও স্পর্শ থেকে পাওয়া অনুভূতিগুলো সামঞ্জস্যকরন। তারপর সেসব থেকে একটি ক্ষণস্থায়ী কিন্তু শক্ত ধারণা তৈরি করে।

কল্পনার সময় আমাদের স্নায়ুসঙ্কেতগুলো সামনে থেকে পেছনে (fronto-parietal) যায় কিন্তু বাস্তবের সিদ্ধান্তের সময় পেছন থেকে সামনে (occipito-parietal) যায়।

কাজের বাহিরে মানুষ দিবা স্বপ্ন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মন ঘুরে বেড়ায়। এরপরে কোন কাজে ব্যস্ত হবে সে বা ঘটে যাওয়া কোন কাজ নিয়ে সে ভাবে। এটি স্রেফ দিবাস্বপ্ন , কল্পনা নয়।

কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলে স্মৃতিগুলো সাময়িক ৯০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। পরে সেগুলো আবার একত্রিত হয়।

কল্পনার সীমাবদ্ধতা:

মানুষ যখন ভয় বা সামাজিক চাপ বা আঘাত নিয়ে বড় হয় তার মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস সঙ্কুচিত হয় কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে ভবিষ্যতে র কল্পনার শক্তি হারিয়ে ফেলে। সে মানুষ বতর্মান নিয়েই ব্যস্ত হয় ও সামনে এগুনোর পথ খুঁজে পায় না। এরপর কি হবে, এসময় কিভাবে বেঁচে থাকবো, কি করবো ইত্যাদি চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে মস্তিষ্ক। পরবর্তী সময়গুলো নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে মন যে ভবিষ্যতের চিন্তাটা সেসময় আর থাকে না।

কেউ যখন কল্পনা করতে পারেনা বুঝতে হবে মনের কর্মক্ষেত্র কমে গেছে। এরপরও কল্পনা করতে কেউ সক্ষম হলে তাকে স্মার্ট মানুষ ই বলতে হবে।

মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর কি কল্পনা করার ক্ষমতা আছে?


চিত্র, কোকো স্ত্রী গরিলা , সে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানে এবং f MRI স্ক্যানে দেখা যায় , সে কল্পনা করতে জানে।

অন্যান্য প্রাণীর কল্পনা:

কয়েক দশকের পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে, বিশেষ কিছু পরিস্থিতির শিকার হলে প্রাণীরাও কল্পনা করে। এটা সহজাত ক্ষমতা মানুষছাড়া আরও কিছু প্রাণীর। যেমন গরিলা, শিম্পাঞ্জি, কুকুর, বিড়াল, ঘোড়া, হাতি ও কিছু পাখির। চারিপাশের পৃথিবী থেকে ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রাপ্ত মনের আংশিক বা সম্পূর্ণ সক্রিয় ব্যক্তি প্রতিক্রিয়ার ফলে তাদের মনেও কল্পনার জন্ম হয়। এর মাধ্যমে প্রাণীদের মন অনেক সমস্যার সমাধান খোঁজে।

তাদের অতীতের স্মৃতি ,কাল্পনিক কোন খেলনা নিয়ে তারা কল্পনায় ডুবে থাকে। কখনো কোন বিশেষ খাবার বা সঙ্গমের কল্পনাও তারা করতে পারে।

কাকামা নামে এক শিম্পাঞ্জির বাচ্চা কাঠের টুকরো কে খেলনা বা পুতুল বানিয়ে সন্তানের মতো আদর করছে, খেলছে, এমন দেখা গেছে। এটি তার কল্পনার ফসল। শিম্পাঞ্জি র বাচ্চাকে পাখির ছবি দেখিয়ে সেটা কি জিজ্ঞেস করা হলে, সে জানায় সেটা সে।

ক্ষুধার্ত কুকুরও ক্ষুধা পেলে অতীতের কোন খাদ্যবস্তুর কল্পনা করে, তখন ডাকে সাড়া দেয় না সে।


"স্বাস্থ্যের কথা " বাংলা ভাষায় অনলাইন স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বিশেষজ্ঞ মানবিক চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত। নিম্নোক্ত নম্বরে বিকাশ এর মাধ্যমে দান করে চিকিৎসা গবেষণায় সহায়তা করুন; +৮৮০১৮১৩৬৮০৮৮৬।

সূত্রঃ Imagination and Reality Look Different in the Brain https://www.robhopkins.net/2018/01/04/alex-schlegel-on-imagination-the-brain-and-the-mental-workspace/ Do animals have imagination? Here's How Imagination Works

মন্তব্যসমূহ