সারোগেসি কি? বাংলাদেশে ও ইন্ডিয়ার আইনে সারোগেসি বৈধ!

২০১৩ সালে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা এবং সাবধানতার সাথে তাদের সমস্ত বিকল্প বিবেচনা করার পরে, শাহরুখ এবং গৌরী খান তাদের তৃতীয় সন্তান আব্রামের জন্য আইভিএফ (ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন) এর মাধ্যমে সারোগেসি বেছে নিয়েছিলেন। তাদের সিদ্ধান্ত অনেকেই গ্রহণ করেননি এবং পরিবর্তে প্রচুর সমালোচনা পেয়েছেন।কিন্তু কি এই সারোগেসি

সারোগেসি / গর্ভভাড়া 

১ম ও ২য় জনের সন্তান ৩য় জনের জরায়ুতে বড় হচ্ছে!


সারগেসি শব্দের একেবারে সোজাসাপ্টা অর্থ হল জরায়ু বা গর্ভাশয় ভাড়া। একজন নারীর গর্ভে অন্য দম্পতির সন্তান ধারণের পদ্ধতিকে সারোগেসি বলে। আইভিএফ পদ্ধতিতে স্ত্রীর ডিম্বাণু ও পুরুষের শুক্রাণু দেহের বাইরে (টেস্ট টিউবে) নিষিক্ত করিয়ে তা নারীর গর্ভাশয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।

অনেক চেষ্টার পরেও যখন সন্তান লাভের আর কোন আশা থাকে না তখনই কোনো দম্পতি সারোগেসির শরণাপন্ন হন। সারোগেসির পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে কয়েকটি হল-

১) বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও গর্ভপাত হয়ে যাওয়া।
২) অসময়ে নারীর মেনোপজ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
৩) আইভিএফ চিকিৎসার মাধ্যমেও গর্ভধারণ না হওয়া।
৪) জরায়ুতে অস্বাভাবিকতা দেখা যাওয়া কিংবা কোন অস্ত্রোপচারের জন্য জরায়ু যদি বাদ দেয়া হয়ে থাকে।

উপরোক্ত এই কারণগুলির মধ্যে যেকোনো একটি কারণ দেখা দিলেই দম্পত্তিরা সারোগেসির শরণাপন্ন হতে পারেন।

এছাড়াও অনেক কারনেই শৌখীন মানুষ সারোগেট বেবি নিয়ে থাকেন, যেমন-
  • সন্তান ধারনের কষ্ট সহ্য না করার ইচ্ছা,
  • ব্যস্ততার কারনে বা
  • শারীরিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে,
  • বিয়ে না করে সিংগেল ফাদার বা মাদার হওয়ার ইচ্ছা, ইত্যাদি

 

এধনের সারগেট বেবি নেওয়ার প্রবনতা ইন্ডিয়ায় কয়েক বছর আগেও ধনীদের ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।

শাহরুখ খান, আমির খান তাদের একাধিক সন্তান থাকার পরেও সারোগেট বেবি নিয়েছেন, এদিকে আবার বিয়ে না করেই করণ জোহার, তুষার কাপুড়, একতা কাপুড়, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া এবং আরো অনেকেই সারোগেট বেবি নিয়েছেন।
 
সেলিব্রিটিদের শখ যখন সারোগেট বেবি!


সারোগেসির ধরণ 


সারোগেসি সাধারণত তিন রকমের হয়। একটি হচ্ছে আংশিক  এবং আরেকটি হচ্ছে প্রকৃত সারোগেসি।

১) আংশিক সারোগেসি অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। সন্তানধারণে এখানে মা কোন ভূমিকাই পালন করেন না। বাবার শুক্রাণু আর সারোগেট মায়ের ডিম্বানু থেকে জন্ম হয় শিশুর।

২) প্রকৃত সারোগেসি তে মায়ের ডিম্বাণু এবং বাবার শুক্রাণু নিয়ে ল্যাবে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সেই এম্ব্রায়ো বা ভ্রূণ সারোগেট মায়ের ইউটিরেস বা জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। বর্তমানে সারোগেসির এই পদ্ধতিটি বেশিরভাগ দম্পতি গ্রহণ করেন।

৩) ট্রু সারোগেসি পদ্ধতি অবলম্বন করলে দম্পতির পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না। কারণ এই পদ্ধতিতে মায়ের ডিম্বাণুর সাথে স্পার্ম ব্যাংকের অন্য পুরুষের শুক্রাণু নিষিক্ত করে দেয়া হয়। কিম্বা বাবার শুক্রাণু অন্য মহিলার ডিম্বানুর সাথে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয় ও তা অন্য মহিলার গর্ভে বড় করানো হয়।




আংশিক  সারোগেসির ক্ষেত্রে সাধারণত সারোগেট মাদারের ডিম্বাণু এবং গর্ভ ভাড়া নেওয়া হয়। এর ফলে এই পদ্ধতিতে সারোগেসির ক্ষেত্রে সন্তানের ওপর সারোগেট মাদারের একটি জৈবিক অধিকার থেকেই যায়।


টেস্ট টিউব বেবি ও সরোগেট বেবির পার্থক্য :
বেবি এখন টেস্ট টিউবে !

টেস্ট টিউব চিকিৎসায় নারীর ডিম্বাণু পুরুষের শুক্রাণুর সাথে নারীর দেহের বাইরে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এটি একটি পেট্রি-ডিশে ল্যাবে প্রক্রিয়া করা হয় যতক্ষণ না এটি একটি ভ্রূণে পরিণত হয়। একবার এটি সম্পন্ন হলে, তারপর এটি মায়েদের শরীরের ভিতরে রোপণ করা হয় এবং গর্ভাবস্থা তার প্রক্রিয়া শুরু করে।

তবে আইভিএফ পদ্ধতিতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিষিক্ত করা কে টেস্টটিউব বেবী মনে করা যায় না। টেস্টটিউব বেবি এবং সারোগেছি ভিন্ন পদ্ধতি। আইভিএফ এবং সারোগেসির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল যে ডিম্বাণুটি আইভিএফ-এ শরীরের বাইরে নিষিক্ত করা হয়, যেখানে সারোগেসিতে, নিষিক্ত ডিমগুলি সারোগেটের গর্ভে রোপণ করা হয় এবং সে নয় মাস পর্যন্ত বাচ্চাকে বহন করে।


বাণিজ্যিক  সারোগেসি

বানিজ্যিক সারোগেসি তে একটা নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে একজন মা তার নিজের গর্ভে অন্য একজনের সন্তান ধারন করেন। এ ক্ষেত্রে সারোগেট সারোগেট মা পান অর্থ এবং কাংখিত  প্যারেন্টস্‌ পান সন্তান।

২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারত ছিল কমার্শিয়াল সারোগেছির হটস্পট, সারগেছি বিল ২০১৬ সালে পাশ হবার পর বানিজ্যিক সারোগেছি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তবে "পরার্থ সারোগেছি" চালু আছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বানিজ্যিক সারোগেছি এখনো প্রচলিত আছে, আবার অনেক দেশেই এটা অবৈধ।


অল্ট্রুস্টিক / পরার্থবাদী সারোগেসি

পরার্থবাদী সারোগেসি বলতে সেই সারোগেসি চুক্তিগুলিকে বোঝায় যেখানে সারোগেট আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায় না।  বেশিরভাগ পরোপকারী সারোগেসি চুক্তিতে, সারোগেট হল অভিপ্রেত পিতামাতার (পরিবারের সদস্য/ঘনিষ্ঠ বন্ধু) একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, শ্বাশুড়ি, খালা ইত্যাদি ।

সারোগেছির খরচ


ইন্ডিয়াতে একটা সারোগেট সন্তানের জন্য ১০ লাখ থেকে ৩০/৪০/৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।

বিভিন্ন দেশে সারোগেছি সংক্রান্ত আইন কানুন নিয়ে-

কিছু দেশে, যেমন ফ্রান্স, ইতালি এবং জার্মানিতে, সারোগেট মাদার ব্যবহার করা  অবৈধ।  সুতরাং, এটি এখানে আইন দ্বারা নিষিদ্ধ।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সারোগেসি জনপ্রিয়, এবং কিছু শীর্ষ দেশগুলির মধ্যে রয়েছে ইউক্রেন, কলম্বিয়া, মেক্সিকো এবং জর্জিয়া।

ইসলামিক আইনে সারোগেছি কি বৈধ! 


ইসলামিক আইনে টেস্টটিউব বেবি হালাল হলেও, সারগেছি হারাম।

ইসলামী স্কলারদের মতে, এই জাতীয় সারোগেট মাতৃত্বের অনুমতি নেই কারণ এটি জিনা (ব্যভিচার) এর সমতুল্য, যেহেতু সারোগেট তার বৈধ স্বামী নয় এমন ব্যক্তির নিষিক্ত ডিম বহন করে। যে সন্তানের জন্ম হয়, বৈধ বিবাহের মাধ্যমে তার কোন বংশগত সম্পর্ক নেই, এই কারনে সন্তানটি অবৈধ বলে গন্য হবে। যেহেতু সন্তানটি অবৈধ, সেহেতু এই পদ্ধতি অর্থ্যাৎ সারোগেছি কে হারাম বলা হয়েছে। এটি একটি জৈব-নৈতিক এবং ধর্মীয় প্রশ্ন। আইভিএফ চিকিত্সা এবং সারোগেসি সবচেয়ে বিরোধপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয়।

ইসলামিক ধর্মতত্ত্ব অনুসারে সারোগেসির ধারণাটি বাতিল এবং অকার্যকর। কারণ নিষিদ্ধ ভ্রুন বা ব্লাস্টোসিস্টের গঠন শুক্রাণু থেকে গঠিত যা তার সাথে বিবাহিত নয় এমন একজন মহিলার জরায়ুতে স্থানান্তরিত হয়।

ইসলামী স্কলারদের মতে, এই জাতীয় সারোগেট মাতৃত্বের অনুমতি নেই কারণ এটি জিনা (ব্যভিচার) এর সমতুল্য, যেহেতু সারোগেট তার বৈধ স্বামী নয় এমন ব্যক্তির নিষিক্ত ডিম বহন করে। যে সন্তানের জন্ম হয়, বৈধ বিবাহের মাধ্যমে তার কোন বংশগত সম্পর্ক নেই, এই কারনে সন্তানটি অবৈধ বলে গন্য হবে। যেহেতু সন্তানটি অবৈধ, সেহেতু এই পদ্ধতি অর্থ্যাৎ সারোগেছি কে হারাম বলা হয়েছে।


সারোগেসি, আইভিএফ ও স্পার্ম ব্যাংক

  1. ইসলামে আইভিএফ ব্যবহার করা বৈধ কিন্তু এটি নিষিদ্ধ হবে যদি একজন মহিলা কেবল গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের "উদ্বেগ" থেকে মুক্তি পেতে চান।
  2. শুধুমাত্র পূর্ণ বয়স্ক দম্পতি যাদের বিয়ে শরিয়া আইন দ্বারা অনুমোদিত তারা সাহায্য চাইতে পারেন। স্পার্ম এবং ডিম্বাণু শুধুমাত্র আইনত বিবাহিত দম্পতি প্রদান করলেই ব্যবহার করা যাবে।
  3. তৃতীয় পক্ষের দ্বারা জৈবিক উপাদান ব্যবহার নিষিদ্ধ. অর্থাৎ দাতা কোষ নিষিক্তকরণের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
  4. একক মহিলাদের জন্য ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। এছাড়াও, ইসলামিক আইন সমকামী দম্পতিদের জন্য এই ধরনের পদ্ধতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে। এটাকে মহাপাপ মনে করা হয়।
  5. ইসলাম নিষিক্ত ভ্রূণ হিমায়িত করার অনুমতি দেয়। কিন্তু শুধুমাত্র একই দম্পতি তাদের ব্যবহার করতে পারেন, এবং যদি তারা এখনও বিবাহিত হয়. বিবাহবিচ্ছেদ বা মৃত্যুর পরে একজন মহিলা বা পুরুষ হিমায়িত ভ্রূণ ব্যবহার করার অনুমতি নেই। আপনি অন্য দম্পতিকে ভ্রূণ দান করতে পারবেন না।
  6. আপনি একটি শুক্রাণু বা ডিম হিমায়িত করতে পারেন, উদাহরণস্বরূপ, কেমোথেরাপি গ্রহণ করার আগে। কিন্তু তালাক বা মৃত্যুর পর এগুলো ব্যবহার করা হারাম। অর্থাৎ তারা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নয়।


উপসংহার :
এটি একটি চুক্তিভিত্তিক অঙ্গীকার যেখানে প্রাকৃতিক বা সারোগেট মা, একটি ফি দিয়ে, প্রাকৃতিক পিতার শুক্রাণু দিয়ে কৃত্রিম গর্ভধারণের মাধ্যমে একটি শিশুকে নিজ জরায়ুতে গর্ভধারণ করেন। তিনি স্বাভাবিক পিতার সন্তানকে জন্ম দিয়ে এবং পরবর্তীতে তার পিতামাতার সমস্ত অধিকার বাতিল করতে সম্মত হন। সন্তানের জন্মের জন্যই এসব পদ্ধতি বেশ বিতর্কিত। নৈতিক,আইনি অ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন আছে।

একজন পুরুষ যদি নিজ বীর্য বা শুক্রাণু বিক্রি করতে পারেন, একজন মহিলা কেন জরায়ু বা ডিম্ব ভাড়া বা বিক্রি করতে পারেন না? 








মন্তব্যসমূহ