পাঙ্গাস মাছ

পাঙ্গাশ নিয়ে নিজের কথা

আমরা সপরিবারে কর্ণফুলী নদীর তীরে থাকতাম তখন। জেলেরা মাঝে মধ্যে ইয়া বড় পাঙ্গাস মাছ ধরত। আট নয় কেজি ওজন হত সেসবের। সেসব পাঙ্গাস মাছের স্বাদ অসাধারণ হত। নিজে খেতাম, শহরে বাবার জন্য পাঠাতাম।

নদীর মাছ ছাড়া, চাষের মাছ খেতাম না। একদিন বাসার পেছনের ব্লকে পলিটেকনিক ছাত্রদের ঘরে গিয়ে পাঙ্গাশ মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। বেশ স্বাদ লাগল। ওরা বলল ছাত্রমানুষ, বাজেট কম, তাই কম দামের মাছ ই তাদের খেতে হয়। এ মাছে কাঁটা কুটা নেই, রান্না করতেও সুবিধা।

উচ্চ প্রোটিন ও মাছে বেশ তেল। তারপর থেকে প্রায়ই আমার বাচ্চাদের জন্য পাঙ্গাশ মাছ বাজার থেকে কাটিয়ে, চামড়া ছিলে, মাঝের কাটা ফেলে বাসায় নিয়ে যেতাম। যে কোন মাছের গন্ধ মূলত এই কাঁটা ও চামড়ার জন্য হয়। সেজন্য মাছের ফিলেট বিদেশে জনপ্রিয়। আমার বাচ্চারাও কাঁটাহীন মাছের ফিলেট খেয়ে খুশি হত।



পাঙ্গাস মাছ



মেকং নদীর পাঙ্গাস, মেকং জায়ান্ট পাঙ্গাস বিশ্বের যে কোনও মাছের মধ্যে দ্রুততম বৃদ্ধির হারগুলির মধ্যে একটি। এটি মাত্র ছয় বছরে ৪৪০ পাউন্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তারা ৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। অত্যন্ত পরিযায়ী, প্রজাতির স্পন ও বংশবৃদ্ধির জন্য মৌসুমী ভ্রমণের জন্য নদীর বিশাল অংশ এবং খুব নির্দিষ্ট পরিবেশগত অবস্থার প্রয়োজন হয়।

অনেকের কাছে এগুলো সুন্দর মনে হোক বা না হোক, দেশের অর্থনীতিতে এই মাছের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

সদ্য প্রয়াত বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি গীতিকার গাজী মাজহারুল হকের একটা গান ছিল, "পাঙ্গাশ মাছের পেটি আর রুই ম্যাচের কোল, চিংড়ি মাছের দোপেঁয়াজা, ইলিশ মাছের ঝোল। " এই গান জনপ্রিয় হওয়ার কারণ ছিলো এসব খাবার অতুলনীয় স্বাদের।

ইউনিক বা অনন্য স্বাদ বলতে পারেন এসব মাছের ঝোল কে। কী এমন আছে এসব মাছের দেহে। কেন এতো স্বাদের হতো তারা যার রেশ এখনও পুরোনো মানুষজন ভুলতে পারেন না।

নদীর পাঙ্গাস :



পাঙ্গাস ক্যাটফিশ শিং মাছ ও হাঙ্গর মাছের মাঝামাঝি মাছ, বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার এবং পাকিস্তানের তাজা এবং লোনা জলের স্থানীয় একটি প্রজাতি।

সত্যি খুব সুন্দর মাছ নদীর পাঙ্গাশ!

পাঙ্গাসিয়াস এশিয়ান মাছ হাঙ্গর ক্যাটফিশের একটি প্রজাতি। ২২ প্রজাতির মাছ রয়েছে যা এই বংশের অধীনে পড়ে এবং তারা বেশিরভাগই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয়।

বেশিরভাগ প্রাকৃতিক পাঙ্গাসিয়াস মাছ ভিয়েতনামের মেকং নদীর নীচের অংশে বাস করে। প্রজনন ঋতুতে ( ফেব্রুয়ারী থেকে অক্টবর ) এই এশিয়ান মাছ কম্বোডিয়ার উজানে সাঁতার কাটে। একবার ডিম ফুটে এবং সেগুলি বড় হয়ে গেলে , তারা আবার ভিয়েতনামের দিকে সাঁতার কাটে। বড় মাছগুলো একাকী থাকতে পছন্দ করে।

প্রধানত ভিয়েতনাম, লাওস, মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়। এগুলিকে পালনের উদ্দেশ্যে এই জায়গাগুলি থেকে সারা বিশ্বে নেওয়া হয় এবং তারপর সেগুলি বিশ্বব্যাপী মাছের বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।

তাদের আঁশ বিহীন শরীর এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এটি তাদের কোনও অসুবিধা ছাড়াই সাঁতার কাটতে সহায়তা করে। তাদের লম্বা জোড়া দাড়ি এবং চওড়া মুখ রয়েছে। এদের গায়ের রং রূপালি থেকে গাঢ় ধূসর পর্যন্ত হয়ে থাকে।

তাদের একটি অতিরিক্ত শ্বাসযন্ত্রের অঙ্গ রয়েছে এবং তারা তাদের ত্বকের মাধ্যমেও শ্বাস নিতে পারে, যা ইঙ্গিত দেয় যে তারা জলে বাস করতে সক্ষম যেখানে অক্সিজেনের মাত্রা একটু কম।

প্রকৃতিতে তারা শিকারী কিন্তু এই মাছ চাষের ক্ষেত্রে  শান্তিপূর্ণ ধরনের। তবে ছোট অন্যমাছের সাথে রাখলে তাদের খেয়ে ফেলতে পারে। প্রকৃতিতে প্রায় ২০ বছর বাঁচে এরা।



মাছের 🐡 সবচেয়ে পুষ্টিকর অংশ কোনটি⁉️👉



চাষের পাঙ্গাস :


হলুদ লেজ ওয়ালা ইয়েলোটেল ক্যাটফিশ, এটি প্রকৃত বাংলাদেশি চাষের পাঙ্গাস। প্রাপ্যতা: এটি বাংলাদেশের সর্বত্র মোহনা, বড় নদী, লেক , বিল , হিল এবং প্লাবনভূমিতে পাওয়া যায়।

সময়ের সাথে ধীরে ধীরে নদীতে পাঙ্গাস বিলীন হয়ে গেল একসময়। চাষের পাঙ্গাশ বাজার দখল করল। মাছ ব্যবসায়ীরা অধিক লাভের আশায় এর স্বাদের দিক টি ভুলে গেল।

ওজন বাড়াতে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য হরমোন ও এন্টি বায়োটিক মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো হয়। এমনকি কম অক্সিজেন যুক্ত জলেও টিকে থাকতে পারে বলে, ওয়াশার লেগুন ও বর্জ্য ফেলার হ্রদ এ অসাধু মাছ ব্যবসায়ীরা এটি চাষ শুরু করলো।

নোংরা পানিতে চাষের ফলে স্বাদে তারতম্য হয়। ফলে চাহিদা কমে গেলো। অনেকেই সস্তা বলে চাষের মাছ খেতো না। অনেকেই নাক সিটকাতো এই অসাধারণ স্বাদের মাছটিকে নিয়ে।



চিত্র, মজার মাছটি নিয়ে অপপ্রচার করছে কিছু সামুদ্রিক মাছ ব্যবসায়ীরা।

গবেষকেরা বলছেন, পাঙাশ দ্রুত বর্ধনশীল হাঙ্গর প্রজাতি মাছের একটি। এই মাছের ওজন ৬০ কেজি পর্যন্ত হয়। দেশে ইলিশের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনকারী মাছের তালিকায় আছে ক্যাটফিশ।

মৎস্য আইন অনুযায়ী, ১২ ইঞ্চির নিচে পাঙাশ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও জেলেরা তা মানছেন না। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০২০ সালে দেশীয় পাঙাশ মাছকে লাল তালিকাভুক্ত করেছিল। তবে ইলিশ রক্ষা কর্মসূচির প্রভাবে নদীতে ক্যাটফিশ-জাতীয় মাছও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইলিশের মতোই ক্যাটফিশের ভান্ডার ও প্রজননস্থলগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।



প্রতি ১০০ গ্রাম পুষ্টির মান, শক্তি ৯২ কিলোক্যালরি , প্রোটিন ১৫ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ০ গ্রাম, ভালো চর্বি ৩.৫ গ্রাম, কোলেস্টেরল ৮০ মিলিগ্রাম


পাঙ্গাশ মাছের পুষ্টিমান :



ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম পাঙ্গাসিয়াস চাষের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ। এই অঞ্চলের জলের গুণমান এবং তাপমাত্রা তাদের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত, স্বাস্থ্যকর এবং উচ্চ মানের মাছ নিশ্চিত করে। দেশটি দ্রুত এই সুবিধাগুলোকে পুঁজি করেছে এবং প্যাঙ্গাসিয়াস মাছের বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে।

পাংগাস মাছে আছে প্রোটিন ,স্যাচুরেটেড ফ্যাট, কোলেস্টেরল আর সোডিয়াম। ক্যালরির পরিমাণ কম এবং উচ্চ প্রোটিনের আঁধার। এতে অসম্পৃক্ত চর্বিও রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি আমাদের দেহ এবং মস্তিষ্কের সর্বোত্তম স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।


Basa Fish Recipes
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পাঙ্গাস মাছ কে খায়? চীন - পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল জাতি এই মাছ খাওয়ার সবচেয়ে বড় অংশ নেয়। প্রতিবছর 2,035,262.17 টন পাঙ্গাস খাওয়ার মধ্যে প্রতিফলিত হয়।

পাংগাস মাছে সোডিয়াম থাকায় আমাদের শরীরের সোডিয়ামের অভাব পূরণ করে। কম কাটা যুক্ত মাছ হওয়ায় অনেকে এই মাছ খেতে বেশি পছন্দ কর। বিশেষ করে বাসার ছোট বাচ্চারা এই মাছ খেতে পছন্দ করে। এই মাছ কয়েকে বছর আগে এত ছিলো না। কিন্তু বর্তমানে এই মাছ বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হয়। নদীর পাঙ্গাসের স্বাদ সর্বাধিক।



পাঙ্গাসিয়াসের চাহিদা 2022 সালের প্রথমার্ধে একটি সর্বোচ্চ পিচে পৌঁছেছিল, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাজারগুলিতে বছরে দ্বিগুণ-অঙ্কের আমদানি বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ স্তরে আমদানিকে ঠেলে দিয়েছে।

চাষের মাছে রোগ ব্যাধি কমাতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়, কখনো দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাতে হরমন ও রাসায়নিক মেশানো হয়। এসব নিয়ে অনেক ব্লগার, বাজে ইউটিবার অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখন সচেতন। এই মাছ শিশু কিশোরদের পুষ্টির জন্য উপকারী।

এই মাছ খেয়ে কেউ এলার্জির কথা বলেছে, শুনিনি। সুতরাং নির্দ্বিধায় খেতে পারেন এই উপকারী মাছটি।

মানুষের শরীরে এক একটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমে গণ্ডগোল দেখা দিলে এলার্জির বহির্প্রকাশ ঘটে।

তাই এক এক জনের এক এক জিনিসে এলার্জি। যার শরীর যেটাকে ক্ষতিকর ভেবে প্রতিরোধ করে তার সেটাতেই এলার্জি।

তবে সাধারনত ইলিশ ও চিংড়ি মাছে অনেকের এলার্জি হয়। পাঙ্গাশ মাছে তেমন হয়না।

নদীর পাঙ্গাস মাছ মাত্র স্বাদে অতুলনীয়। তবে শুধু পাঙ্গাস নয়, চাষের যে কোন মাছেই গন্ধ হয়। লবন দিয়ে ধুয়ে নিয়ে কিছু লবন বা পেঁয়াজ, রসুন, লেবুর রস ও হলুদের পেস্ট মাখিয়ে রেখে ধুয়ে নিলে অসাধারণ রসনার ঘ্রান হবে। মাছের চামড়া ও কাঁটা ফেলে শুধু পাতলা ফিলেট করে রান্না করলে দারুন স্বাদ হয়, গন্ধও থাকে না।

এ মাছ ভাজা, বেকড, প্যান-ভাজা বা স্টিম করা যায়। এটি দেশীয় মশলাগুলির সাথে ভালভাবে মিশ্রিত হয় এবং একটি অনন্য সুগন্ধযুক্ত স্বাদ দেয়।


নিয়মিত মাছ খেলে কি উপকার হয় জানতে লিংকটি পড়ার অনুরোধ রইল।

মন্তব্যসমূহ