ভ্যাক্সিন কি? কিভাবে তৈরি করে?

ভ্যাক্সিন তৈরিতে এত দীর্ঘ সময় লাগে কেন

ভ্যাকসিন কি?


ভ্যাকসিনগুলিতে একটি সক্রিয় উপাদান (অ্যান্টিজেন) থাকে যা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করতে উদ্বুদ্ধ করে। এগুলিতে অতিরিক্ত উপাদান যেমন প্রিজারভেটিভ, সংযোজন, সহায়ক এবং অন্যান্য উপাদানগুলির ট্রেস থাকতে পারে।

ভ্যাক্সিন কাকে বলে


ভ্যাক্সিন একটি প্রস্তুতি যা রোগের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উদ্দীপিত করতে ব্যবহৃত হয়।

ভ্যাকসিন আমাদের রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়।  ভ্যাক্সিন একটি বিশেষ ধরনের অ্যান্টিজেনিক পদার্থ যা সেই নির্দিষ্ট রোগের বিপক্ষে সক্রিয় প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদান করে।  ভ্যাকসিনটি বিশেষ জীবাণু থেকে তৈরি করা হয়। মেরে ফেলা বা দুর্বল করে দেয়া বা এর বিষাক্ত পদার্থ বা তার পৃষ্ঠের প্রোটিনগুলির একটি থেকে ভ্যাক্সিন তৈরি হয়।

রোগ কমাতে ভ্যাকসিনের সাফল্যের পরামর্শ দেওয়া উচিত নয় যে ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলি আর হুমকি নয়। যদিও ইমিউনাইজেশন ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলিকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে, সেখানে প্রায় টিকা প্রতিরোধযোগ্য রোগের মৃত্যুর বহু রিপোর্ট রয়েছে।

ভ্যাকসিনের সুবিধা কি?

রোগের বিস্তার কমাতে, জটিলতা প্রতিরোধে এবং এমনকি ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে মৃত্যু প্রতিরোধে টিকাদান হল অন্যতম সফল জনস্বাস্থ্য হস্তক্ষেপ। ভ্যাকসিনের সাফল্য শুধু রোগ কমাতে নয়, বরং ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলি আর হুমকি নয়। যেমন করোনা, পোলিও এসব মারণঘাতী রোগকে আমরা হারিয়ে দিয়েছি।

কোনো ভ্যাকসিনই ১০০% সুরক্ষা এবং ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা দেয় না। যার অর্থ ভ্যাকসিন প্রাপ্তদের মধ্যে কতটা ভালভাবে অসুস্থতা প্রতিরোধ করে তা টিকা দেওয়া ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লু ভ্যাকসিন বয়স্কদের ফ্লু ধরার বিরুদ্ধে রক্ষা করে না সেইসাথে এটি অল্প বয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো রক্ষা করে। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ফ্লু-এর বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া বয়স্ক ব্যক্তিদের কম গুরুতর রোগ হয়েছে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং মারা যাওয়ার সম্ভাবনাও কম।

যদি পর্যাপ্ত লোককে টিকা দেওয়া হয়, তাহলে ইমিউনাইজেশন পুরো জনসংখ্যাকে সংক্রামিত করা রোগজীবাণুকেও বন্ধ করতে পারে। একে বলা হয় হার্ড ইমিউনিটি। এছাড়াও টিকা দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কিছু লোক ভ্যাকসিনের মৃদু প্রতিক্রিয়ায় ভোগে।

ডাঃ এডওয়ার্ড জেনার বিশ্বের প্রথম সফল ভ্যাকসিন তৈরি করেন। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে কাউপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গুটিবসন্ত থেকে প্রতিরোধী। ১৭৯৬ সালের মে মাসে, ইংরেজ চিকিত্সক এডওয়ার্ড জেনার এই আবিষ্কারের প্রসার ঘটান এবং ৮ বছর বয়সী মালীর ছেলে জেমস ফিপসকে দুধের দাসীর হাতের কাউপক্সের ঘা থেকে সংগৃহীত পদার্থ দিয়ে টিকা দেন।(হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই পরীক্ষাটি ভয়ঙ্করভাবে অনৈতিক ছিল, তবে এটি অন্য দিনের আলোচনার জন্য একটি বিষয়।)

ভ্যাকসিনগুলির অসুবিধা কি

ভ্যাকসিনগুলির প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার জন্য কিছু ঝুঁকি থাকে, সবচেয়ে সাধারণ হল ইনজেকশনের জায়গায় লালভাব এবং ব্যথা বা জ্বর এবং অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া। খিঁচুনি এবং নিউরোলজিক অবস্থা গুইলিয়ান-বারের মতো আরও গুরুতর জটিলতাগুলিও রিপোর্ট করা হয়েছে তবে ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগের জটিলতা এবং মৃত্যুর তুলনায় খুব কমই এবং খুব কমই ঘটে।

ভ্যাক্সিন তৈরিতে এত দীর্ঘ সময় লাগে কেন!

ভ্যাক্সিন তৈরিতে এত দীর্ঘ সময় কেন লাগে সেটা আমাকে প্রায় সময় শুনতে হয়েছে করোনা মহামারীর সময় । আমরা এর চট জলদি জবাবও দিতে পারিনা । কারণ ভ্যাক্সিন তৈরী একটু জটিল ও একাধিক ধাপ যুক্ত প্রক্রিয়া। প্রতিটা ধাপের সাফল্যের পর পরবর্তী টা শুরু হয়। এখানে আগে থেকে কিছু প্রস্তুত করে রাখাও সম্ভব নয়।

ভ্যাক্সিন তৈরির প্রধান প্রতিবন্ধকতা:

ভাইরাসের মিউটেশন বা রূপান্তর হল ভ্যাক্সিনের প্রধান অন্তরায়। বর্তমান করোনা ভাইরাসটি প্রতিনিয়ত তার জেনেটিক কোড পরিবর্তন করছে। যখনি ভাইরাস পোষক দেহের রোগ প্রতিরোধ হতে বাধাপ্রাপ্ত হয় , তার রিসেপ্টরের প্রোটিন অনুর সামান্য পরিবর্তন করে। ধরুন কোন বড় শব্দের কোন অক্ষরকে সরিয়ে দিল । এতে পুরো শব্দের অর্থ বদলে যাবে। পোষক দেহের এন্টিবডিকে সে ফাঁকি দিয়ে কোষের ভিতরে ঢুকে যাবে। ভ্যাকসিন হলো ডিকশনারির মতো। ভ্যাক্সিন হতে যে সময় নিবে তাতে যদি ভাইরাস একাধিক মিউটেশনে যায়, নতুন শব্দের মতো নবরূপ নেয়, সে শব্দের অর্থ ভ্যাক্সিন নামক ডিকশনারিতে নাও মিলতে পারে । তখন পুরো প্রক্রিয়া ভণ্ডুল হয়ে যাবে ।

আমি সংক্ষেপে ভ্যাক্সিন তৈরির ধাপগুলো আলোচনা করি ।

ভ্যাক্সিন তৈরীর ছয়টি পর্যায় 



1, অনুসন্ধান মূলক গবেষণা কাল:   ভ্যাক্সিন তৈরির পরিকল্পনা হয় কোন দুর্বলকৃত ভাইরাস কে এন্টিজেন হিসেবে নির্বাচন করা হয় যেটা ঐ ভাইরাস কর্তৃক সৃস্টি রোগকে প্রতিরোধ করতে পারবে ।

2, প্রি-ক্লিনিকেল পর্যায়: গবেষক প্রতিষ্ঠান কোন জৈব টিস্যু , সেল বা প্রাণীর শরীরে এন্টিজেন প্রয়োগ করে। যদি প্রাণীটির কোন ক্ষতি হয় বা কোন এন্টিবডি তৈরি না হয় , তবে গবেষণা এখানেই শেষ । অনেক কোম্পানি এতটুকু এসে আর এগোতে পারেনি ।

3, ক্লিনিকেল পর্যায়ের বিকাশ: এটার জন্য গবেষকদের একজন স্পন্সর লাগে , স্পন্সর উক্ত ভ্যাক্সিন এর ক্লিনিকেল টেস্ট এর জন্য ওই দেশের ঔষধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কে অনুরোধ জানায় ।

ঔষধ প্রশাসন রিভিউ বোর্ড গঠন করে তাদের ভ্যাক্সিন এর গ্রহণযোগ্যতা দেখে । যুক্তি গ্রাহ্য হলে আবেদন মঞ্জুর করে । অতঃপর তিনটি পর্যায়ে ক্লিনিকেল টেস্টিং করে ।

  • স্টেজ 1, প্রথমে অল্প সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবককে ট্রায়াল দেয়।
  • স্টেজ 2, তাদের কাছ থেকে এর কার্যকারিতা দেখে এন্টিবডি মাত্রা ,ডোজ, নির্ধারণ করে।
  • স্টেজ 3, অতঃপর বৃহৎ সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক কে ট্রায়াল দেয়া হয় । তারপর এর কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়।


4, নিয়ন্ত্রণ কমিটির পর্যালোচনা ও সনদ: তিন টি ক্লিনিকেল স্টেজ পার হবার পর ভ্যাক্সিন উদ্যোক্তা নিরাপদ বায়োলজি সনদের জন্য ঔষধ প্রশাসনে আবেদন করেন।

5, ভ্যাক্সিন উৎপাদন: ঔষধ প্রস্তুত কারক কোন কোম্পানির সাথে ভ্যাক্সিন উৎপাদন এর জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। কোম্পানী সমূহ নিজেরা লাভবান হবার বিনিময়ে আলাদা ভৌত কাঠামো ,কর্মী ও যন্ত্রপাতি নিয়োগ দেয়।অতঃপর বড় ও ব্যাপক ভ্যাক্সিন উৎপাদন শুরু হয় ।

6. মান নিয়ন্ত্রণ : অংশীদাররা ভ্যাক্সিন এর সত্যিকার কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মনিটর করে। প্রয়োজনে তারা ফ্রি কিছু স্যাম্পল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ সরবরাহ করে সেটার ফলাফল প্রত্যক্ষ করেন। এটাকে চতুর্থ ফেজ ট্রায়াল বলা হয় ।

এটার মাধ্যমে Vaccine Adverse Event Reporting System (VAERS) এবং Vaccine Safety Datalink তৈরি হয় ।

পুরো প্রক্রিয়া সফল হতে একদল দক্ষ গবেষক ,নীতিনির্ধারক, অংশীদার, জনগণের সহযোগিতা ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন। বিশেষতঃ ক্লিনিকেল ট্রায়ালের জন্য অনেক দেশের জনগণ হতে পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক হতে রাজি হোন না। এটার জন্য সাধারণত বার থেকে আঠারো মাস সময় লেগে যায়।

সূত্র: সিডিসি ,

মন্তব্যসমূহ