ইসরাইল বিহীন মধ্যপ্রাচ্য এখন কেমন হত!

ইসরাইল বিহীন মধ্যপ্রাচ্য এখন কেমন হত!

ইসরাইল বিহীন মধ্যপ্রাচ্য এখন কেমন হত!


আনুমানিক ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, ইস্রায়েল রাজ্যটি অ্যাসিরিয়ান রাজা তিগলাথ-পিলেসার তৃতীয় দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল।  পলেষ্টীনীয় রাজ্যও ধ্বংস হয়ে যায় সেই সাথে।  অ্যাসিরিয়ানরা উত্তর ইস্রায়েলীয় রাজ্যের বেশিরভাগ জনসংখ্যাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, আর এইভাবে "ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া উপজাতি" তৈরি হয়েছিল।  


ইসরাইলের দীর্ঘ ইতিহাসে, জেরুজালেমকে ৫২ বার আক্রমণ করা হয়েছে, ৪৪ বার দখল ও পুনরুদ্ধার করা হয়েছে, ২৩ বার অবরোধ করা হয়েছে এবং দুইবার ধ্বংস করা হয়েছে।

খোলাফায়ে রাশিদুন কর্তৃক জেরুজালেম প্রথম অবরোধ হয় ৬৩৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে, শহরটি মুসলিমরা জয় করে ও ফিলিস্তিনের উপর আরবদের নিয়ন্ত্রণকে সুদৃঢ় করে, যা ১০৯৯ সাল অর্থাৎ প্রথম ক্রুসেড পর্যন্ত দখলীকৃত ছিল। কিন্তু এরপর হতে ইউরোপীয় খ্রিস্টান যাজকদের দ্বারা ক্রুসেডের সূচনা হলে এর দখল বারবার হাতবদল হয়। 

সর্বদা একটি প্রধান মধ্যপ্রাচ্য শক্তি, ইসরাইল এখন কেন্দ্রের মঞ্চেই রয়েছে।

" যদি কখনো ইসরাইল রাষ্ট্রের পতন ঘটে " এমন ইচ্ছে কেন হচ্ছে, তবে কি ইসরাইলকে পরাশক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন! তার পতন ঘটানো সম্ভব নয়! পরমাণু অস্ত্র ব্যতীত ইসরাইলের এমন কোন অর্থনৈতিক সম্পদ নেই যা তাকে পরাশক্তি দান করতে পারে।

অতীত ও বর্তমানের ইহুদি-বিদ্বেষীরা রাজনৈতিক ভাবে ইস্রায়েল বিরোধী চিন্তা করে দিনের প্রায় পুরো সময় ব্যয় করে। এক গোয়েন্দা তথ্য মতে, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ তার জেগে থাকার মুহূর্তগুলোর বেশিরভাগ ইস্রায়েলের ধ্বংসের চিন্তা করে কাটিয়েছেন। কিন্তু ইসরাইল বহাল তবিয়তে টিকে আছে। বরং ইরানের অস্তিত্ব ইরাকের মত হতে পারে যেকোন সময় ।

ধরুন ইসরাইল রাষ্ট্র টি মধ্যপ্রাচ্যে নেই। ইস্রায়েল-মুক্ত মধ্য প্রাচ্য কেমন হবে?

প্রথমত এই অঞ্চলে একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আর আরব দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে শত্রুতা, স্বৈরশাসন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক সমস্যা তখনও থাকবে। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং অন্যান্য আরব নেতাদের তাদের ক্ষুধার্ত জনগণের ক্রোধ ও হতাশাকে অপসারণের জন্য একটি নতুন বলির পাঠা (ইসরাইল বাদে) খুঁজে বের করতে হবে। কারন ওই অঞ্চলে তেল নেই।

প্যালেস্তাইন এখনও অনুন্নত থাকবে আগে যেমন ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের সব আরবদেশগুলোর সম্মিলিত মোট দেশীয় উত্পাদন স্পেনের চেয়েও কম। সেটা কি বৃদ্ধি পাবে ? 

বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ জন্মহার সেখানে । বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি এখনও বেকার থাকত, তাদের শাসকদের অক্ষমতা বা অযোগ্যতার কারণে কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো তৈরি করতে পারত না।

পূর্ব জেরুসালেম এবং পশ্চিম তীর এখনও জর্দানের রাজধানী আম্মান থেকে শাসিত হবে, গাজা উপত্যকাটি এখনও কায়রো থেকে শাসিত হবে এবং গোলান হাইটস এখনও দামেস্ক থেকে শাসিত হবে যেমন টি ইসরাইল দখলের আগে ছিল। সিরিয়া কখনোই লেবাননের খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের সহ্য করতে পারত না। ফলে লেবাননে সিরিয়ান আর্মির দাপট থাকত আগের মত।

মিশর তার দেশের কপটিক খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের এখনও ফাঁসি দিত । আরব বিশ্বের রাজধানী হওয়ার জন্য কায়রো , বাগদাদ, দামেস্ক, আঙ্কারা ও রিয়াদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত। কুর্দিরা এখনও তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রের জন্য ইরাক, তুরস্ক, সিরিয়া এবং ইরানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম চালাত।

ইহুদি বিদ্বেষী রাজনীতি ব্যতীত এবং ইস্রায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার এক-রাষ্ট্র বা দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান না হলেও, এখনও এই গ্রহে কমপক্ষে ১৩০ কোটি মুসলমান বাস করে। যদি তাদের মধ্যে কেবল ১ শতাংশ বাস্তববাদী হয় , এর অর্থ বাকি ১২০ কোটি মুসলমানের কল্পনা পরিবর্তন করে দিয়েছে ইসরাইল। মুসলমানরা নিজেদের পুরোনো গৌরবময় অধ্যায় ও ভুলে গেছে এই ইহুদি বিদ্বেষের কারনে।

কিন্তু উপরের আলোচনায় ইসরাইল বিহীন মধ্যপ্রাচ্যের কি খুব বড় পরিবর্তন হত ?

ইহুদি রাষ্ট্রটি গঠনের অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে। মানুষ এখনো ইসরাইল রাষ্ট্রটির পতনের স্বপ্ন দেখে ! ছয়টি আরব রাষ্ট্র ১৯৭৩ সালে এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়েছিল। গো হারা হেরে এসেছিল। মিশর হারিয়েছিল সিনাই উপত্যকা, সিরিয়া হারিয়েছিল গোলান মালভূমি ও জর্ডান হারালো পশ্চিম তীর।

ক্ষুদ্র অথচ শক্তির প্রতীক হল ইসরাইল।

ছোট্ট একটি দেশ ইসরাইল, যার অর্ধেকের বেশি মরুভূমি। তবুও সে নিজ খাদ্য উৎপাদনে সফল। আরব ও ফিলিস্তিনিরা এই ইসরাইল রাষ্ট্রের বাস্তবতা এখনো মানতে চায়না । যে রাষ্ট্রের শক্তি অনুভব করা যায়, সে রাষ্ট্রের সাথে শান্তিচুক্তি তে আবদ্ধ হতে শুধুই কালক্ষেপণ করছেন ফিলিস্তিনের নেতারা।

কারন ওই একটাই , " যদি কখনো ইসরাইল রাষ্ট্রটির পতন হয়!" কে বা কারা পতন ঘটাবে ! সে প্রশ্নের উত্তর নেই আরবদের কাছে।


১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ৫০% ভূমির বিনিময়ে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র ঘোষণা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, ব্রিটিশরা তাদের ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেট থেকে সরে আসে এবং জাতিসংঘ এই অঞ্চলটিকে আরব ও ইহুদি রাষ্ট্রদুটির মধ্যে ভাগ করে দেয়, যা আরবরা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই প্রত্যাখ্যান এখনো চলছে। আরবদের লক্ষ্য ছিল প্রাথমিকভাবে দেশভাগের প্রস্তাব রোধ করা এবং ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা রোধ করা।  ... 14 মে, 1948-এ ইসরায়েল তার স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর, অন্যান্য আরব বাহিনী প্যালেস্টাইনি আরবদের সাথে প্রাক্তন ফিলিস্তিনি ম্যান্ডেটের ভূখণ্ডে আক্রমণ করার জন্য যোগদানের সাথে লড়াই তীব্রতর হয়।


বাস্তবতা হল আরবদের জোর সমর্থন সত্বেও  ফিলিস্তিনিরা জাতিসংঘের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তাদের ভূমি দখল হয়ে তা ১৫% এ নেমে এসেছে।

ইসরাইল পেট্রোডলার ছাড়াই মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় ধনী রাষ্ট্র, কাতার , বাহরাইনের চেয়ে বেশি জাতীয় আয় তাদের, সামনে আছে কেবল ই আমিরাত । 

ফিলিস্তিন যত ছোট দেশ হোক, স্বাধীন রাষ্ট্র হলে তারও অনেক মানবসম্পদ রয়েছে। ফিলিস্তিনের চেয়ে ছোট রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর, এন্ডোরা কিংবা লুক্সেমবার্গ পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র । কিন্তু কিসের স্বপ্ন দেখে ফিলিস্তিনের নেতারা বারবার পিছিয়ে আসছেন শান্তিচুক্তি থেকে জানিনা। সেটা এই স্বপ্নটাই হয়ত , যা আরবরা দেখাচ্ছে অসহায় ফিলিস্তিনিদের।




শান্তিচুক্তি হলে, ফিলিস্তিনিরা ভূমির কাঙ্খিত ভাগ পাবেনা জানি, পবিত্র জেরুজালেম পাবেনা জানি, তবুও একটি রাষ্ট্র ত পাবে। সে রাষ্ট্রটি গড়েই নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারে। প্রবল শক্তিধর রাষ্ট্রের পাশে এই পৃথিবীর ক্ষুদ্রতর দেশগুলো উন্নতি করে চলেছে নিয়মিত। কিউবা, তাইওয়ান, মালদ্বীপ , বাংলাদেশ প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোন রাষ্ট্র থাকল কি থাকল না তা দিয়ে কিছুই এসে যাবেনা ফিলিস্তিনের।

যদি দৃঢ় চিত্ত থাকে, তবে অবশ্যই একদিন হারানো জমি ফেরত পাবে ফিলিস্তিনিরা , যেভাবে ইহুদিরা হারানো দেশ ফেরত পেয়েছে (তাদের মতে) । তার আগে অসুরের সাথে ইট পাটকেল দিয়ে যুদ্ধ না করে নিজেদের শক্তিক্ষয়টা কমিয়ে আনুক ফিলিস্তিন।

আন্তর্জাতিক সহানুভূতি, জাতিসংঘের রিলিফ , আরবদের যাকাত ফেতরা নিয়ে আর কতকাল বেঁচে থাকবে তাদের শিশুকিশোররা ! এই শিশুকিশোররা একটা নতুন দেশ গড়তে পারে , নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু তাদের কেবল ব্যবহার করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির গুটি হিসেবে ।

আমার মতে, শুধু পর্যটন খাতে কোটি কোটি ডলার রোজগার করত নতুন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। যীশুর জন্মস্থানসহ অসংখ্য পুরাকীর্তির স্থান সেথায় । অথচ তারা ও তাদের মতো আরো অনেকে খালি স্বপ্নই দেখছে, ইসরাইল রাষ্ট্র পতনের। কিভাবে পরমাণু শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের পতন হবে তা কি কেউই বলতে পারে!

"যদি" এই প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া কি স্বাভাবিক!

বাস্তবে, যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইউরোপ আমেরিকার সায় আছে। সে রাষ্ট্রের "নাই" হয়ে যাওয়াটা স্বপ্ন ই বটে। কোন রাষ্ট্র স্বাধীন হবে, কারা নিয়ন্ত্রণ করবে সেই দেশ, কোন দেশ ধ্বংস হবে, এখনো এসব নিয়ন্ত্রণ করছে জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য।

ইরাক থেকে সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান,পূর্ব তিমুর, কুয়েত, ইরিত্রিয়া সবই এই পাঁচ শক্তির ইচ্ছায় হয়েছে। এদের স্বপ্নের সাথে অন্যদের স্বপ্ন মিললে তবেই মিলবে মুক্তি। হামাসের মত কোন দলের পক্ষে সম্ভব নয় ফিলিস্তিন মুক্ত করা। হামাসের মেন্টর ইসলামী ব্রাদারহুড নিজেই এখন ব্রাত্য, নিষিদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে । 

এদেশের স্কুল মাদ্রাসা কলেজ শিক্ষিত লক্ষ লক্ষ মানুষ এমনি অর্থহীন স্বপ্ন দেখে চলেছে দিনরাত। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ভাবে ইসরাইলিদের সাথে ফিলিস্তিনিদের রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের মিলন মিটাতে খুব কম মানুষই চিন্তা করে। বন্ধ হোক এই অন্ধ ইহুদি বিদ্বেষ। দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হোক যা জাতিসংঘ ১৯৫০ সালেই প্রস্তাব করেছে । 


কিন্তু শান্তির পরিবর্তে কট্টর ইহুদীরা অনেক ভুল করেছে। কট্টর ইহুদীরা  শান্তির পরিবর্তে, ইসরায়েলিরা যুদ্ধাবস্থা শিথিলকরণকে ঐতিহাসিক ভুল হিসাবে পরিণত করেছে।  বিজয়ের জন্য এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, তারা তাদের প্রধান দুই শত্রু, সিরিয়ান এবং ফিলিস্তিনিদের কাছে সুবিধাজনক চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। 

অনুমিতভাবে, এই প্রস্তাবগুলি বিপরীতমুখী হয়েছিল: সংঘাত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশলগত ছাড় হিসাবে দেখা না গিয়ে, সেগুলিকে ইসরায়েলের মনোবলহীনতার লক্ষণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।  এর ফলে অস্ত্রের জোর এবং সহিংসতার উত্থানের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ধ্বংস করার আরবদের আশা নতুন করে দেখা যায়।  অন্য কথায়, কূটনীতি, অনিচ্ছাকৃতভাবে ইহুদি রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার আরব স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল।


 স্পষ্টতই, আরব প্রত্যাখ্যানের এই প্রাচীর ইস্রায়েলের ক্ষতি করে, একটি সাধারণ জাতি হিসাবে বেঁচে থাকার তার বিরোধিতাকে অস্বীকার করে, এর জনসংখ্যাকে হত্যামূলক আক্রমণের শিকার করে এবং প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।  কিন্তু ইসরায়েল এই আক্রমণ সত্ত্বেও উন্নতি করছে, উচ্চ জীবনযাত্রার মান, একটি গণতান্ত্রিক নীতি এবং একটি প্রাণবন্ত সংস্কৃতি নিয়ে গর্বিত।



এখনো ফিলিস্তিনের মসজিদগুলোর  ইমাম সাহেবরা খুতবা দেন: " আল্লাহর ইচ্ছা, এই অন্যায় রাষ্ট্র ইসরাইল মুছে ফেলা হবে; এই অন্যায় রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুছে ফেলা হবে; এই অন্যায় রাষ্ট্র ব্রিটেনকে মুছে ফেলা হবে।"






মন্তব্যসমূহ