ছাত্রজীবনের বিব্রতকর অভিজ্ঞতা

ছাত্রজীবনের বিব্রতকর অভিজ্ঞতা

ছাত্রজীবনের বিব্রতকর অভিজ্ঞতা 


তখন আশির দশক। বাবা-মা সহ সাতভাই বোনের বড় সংসার। বাবা রেলওয়ের সাধারণ কর্মচারী, হঠাৎ একদিন রিটায়ার্ড হয়ে গেলেন। তিনি পরকাল নিয়ে বেশী ভাবিত থাকতেন বিধায় ইহকালে শেষ বয়সে কোথায় উঠবেন জানতেন না। শেষমেশ এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠলাম। মফস্বলের সাধারণ এক ভাংগাচোড়া স্কুলে ভর্তি হলাম। ঠিকমতো বেতন দিতে না পারলেও অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম প্রথম হয়েই। এরপর শুরু হল বিপত্তি আমাকে নিয়ে।

সে স্কুলের নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা চতুর্থ বিষয় হিসেবে ব্যবসা প্রশাসন পড়তো। স্কুলের জন্মলগ্ন থেকে কেউ কখনো উচ্চতর গণিত পড়েনি বা স্যাররা পড়তে উৎসাহ দেন নি। শুরুতে আমাকে নিবৃত্ত করা হল, কারন কেবল একজন ছাত্রের জন্য একটি নতুন কঠিন বিষয় চালুর কথা গণিত কিংবা ব্যবসা প্রশাসন স্যারের দুজনই গররাজি ছিলেন।

প্রথমতঃ গণিত স্যার সাধারণ গণিতে যতটা দক্ষ উচ্চতর গণিতে নবিস। দ্বিতীয়ত: ব্যবসা প্রশাসন স্যারের ওই বিষয়ে একচেটিয়া কোচিং ছিল, স্কুল শেষ না হতেই স্কুলের একটি শ্রেণীতে শুরু হয়ে যেত তাঁর কোচিং বাণিজ্য। আমার মত দুচারজন ছাত্র কমে যাওয়াটা তার অপছন্দের ছিল।

যাহোক, উচ্চতর গণিতে আমার আগ্রহের কথা হেডস্যারের কানে পৌঁছাল। তিনি ধার্মিক বিদ্যানুরাগী ছিলেন, আমাদের খুব ভাল ইংরেজি পড়াতেন। তিনি শুধু আমার জন্য স্যারদের নির্দেশ দিলেন, উচ্চতর গণিত সেই স্কুলে নতুন বিষয় হিসেবে চালুর জন্য। একজন ছাত্রের জন্য নতুন করে রুটিন করতে হল স্কুলের। প্রথমে একা ক্লাস করতাম, তারপর দুচারজন করে বাড়তে লাগলো ছাত্রছাত্রী। ক্রমে দশজনে গিয়ে ঠেকল আমার সহপাঠীর সংখ্যা। সহপাঠীদের বাবারা আমাকে বাহবা দিত এই উদ্যোগের জন্য।

কোন এক ষান্মাসিক পরীক্ষায় ব্যবসা প্রশাসন স্যার তার প্ৰিয় ছাত্রদের ছেড়ে আমার প্রতি অতিরিক্ত পাহারা দেয়া শুরু করলে, বারংবার তাকে প্রশ্ন বুঝিয়ে দিতে বলি, তিনি বিজ্ঞান বোঝেন না বিধায় এড়িয়ে যান কিন্তু অন্যদের সাথে কিছু কথা বলার সুযোগ ও না পেয়ে বেশ রেগে যায় আমি। প্রশ্নের দুপত্রের এক পত্র ছিঁড়ে ভাঁজ করে উঁকি দিয়ে রাখি খাতার ফাঁকে। ক্লাসের সেরা ছাত্র নকল করছে! তিনি ঠিকই ফাঁদ টি তে পা দিলেন, বেশ ঘটা করে, নকল ধরেছেন এমন ভাব নিয়ে, প্রশ্নের পত্র টি খুলে বুঝতে পারলেন ঘটনা। কেন এমন করলাম অন্য স্যারদের উত্তরে জানালাম উত্তরপত্র লেখা হয়ে গিয়েছে বিধায় ওভাবে রেখেছি। আমার সেই স্যার খুব সরু চোখে দেখছিলো আমায়। বন্ধুরা সবাই খুব মজা পেয়েছিল সেদিন।

গণিত স্যার প্রথম প্রথম সামান্য নার্ভাস থাকতেন কঠিন অংকগুলো নিয়ে। চক ডাস্টার ভেঙে, নোট বইয়ের পাতা ছিঁড়ে, ঘেমে নেয়ে একাকার হতেন। গরমে একদিন মাথা ঘুরে পড়েও গেলেন।

তারপর এভাবে মেট্রিক পরীক্ষা এলো একদিন। সেসময় এসএসসি পরীক্ষা এই নামেই পরিচিত ছিল, ছাত্রছাত্রীদের   জীবনমরণ ও ভবিষ্যৎ  নির্ভর করতো এই  পরীক্ষার উপর। ফেল মানে তার ভবিষ্যৎ শেষ। তাই স্যারদের কড়া নজর ছিল আমাদের দিকে। 

আমরাও সেই দশজন সেই অখ্যাত স্কুল থেকে উচ্চতর গণিতে উচ্চতর নম্বর নিয়েই প্রথম বিভাগে পাশ করলাম। সেসময় এত জিপিএ ৫ ছিলনা, ফেল আর তৃতীয় বিভাগের ভিড়ে অখ্যাত স্কুল হতে প্রথম বিভাগ পাওয়া ছিল বড় অর্জন। সেদিন স্কুলের পরিবেশ ও স্যারদের আনন্দ দেখে দিনটিকে ঈদের দিন মনে হচ্ছিল। 

মন্তব্যসমূহ