কোনও ভিক্ষুকের কাছ থেকে পাওয়া আপনার সেরা শিক্ষা কি

ভিক্ষুকের কাছ থেকে পাওয়া আমার সেরা শিক্ষা 

চিত্র, প্রতীকী ছবি।

রাঙামাটির এক পাহাড়ী এলাকার মফস্বল শহরে চাকুরী করতাম। সেই সুবাদে আশেপাশের মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । এলাকায় অল্প দিনে আমার বেশ নামডাক হয়েছে তাই সকলে বলতে গেলে শ্রদ্ধা করে ।

প্রতিদিন বাজারে আসা যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে এক ভাঙাচোরা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো কবর দেখতাম, যার শুধু বড় এক গেট ছিল। সেটি নাকি মাজার। সন্ধ্যার সময় ঝাঁকড়া চুলের এক ভক্ত, বেশ ভূষা ফকিরের মত, ওই মাজারে দুয়েকটি মোমবাতি জ্বালাত। মাজারটিও নাকি তার মত কোন এক ফকিরের, যার নাকি অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। ফকিরটি মারা যাওয়ার পর কোন এক আর্মির জিওসি সাহেব তাকে রাস্তার ধারের অন্য এক প্রতিষ্ঠানের খোলা জায়গায় কবর দিয়ে যান।

আমি প্রচন্ড বিজ্ঞান মনস্ক ছিলাম বিধায় সেসব শুনলে খুব হাসতাম । মাজারে আর কোন স্থায়ী ভক্ত না থাকলেও ওই ফকির টি সেখানে রাত্রিযাপন করত। টিনের ছাউনি দেয়া ছাদের নিচে চারিদিকে খোলা , কুকুর শিয়ালের ডাকাডাকির মাঝে সে থাকত রাতে। প্রচন্ড ম্যালেরিয়া সঙ্কুল পরিবেশে সে ফকিরটি কিভাবে সেখানে রাত যাপন করতো ভাবলে কষ্ট হত।

চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ, এত বিশাল জমকালো রঙিন সব মাজার দেখেছি, তাই ওই মফস্বলের ছোট মাজার দেখে হাসি আসত আমার। চট্টগ্রামের মাজারগুলো ফুলে ফেঁপে বিশাল সব অট্টালিকা এখনো যার আশেপাশে এমন কয়েক হাজার স্বঘষিত ফকির দরবেশ থাকে। ভিক্ষা বৃত্তি এদের মূল পেশা।

এক এক মাজারের এক এক মহাকাব্য। কোন কোন মাজারের সামনে জুতো পড়ে হাঁটা যাবেনা। জুতা খুলে হাতে নিয়ে মাজার পার হতে হয়। এতে মাজারে শায়িত মহাপুরুষ সব দেখে ফেলবেন, অতঃপর কবরে বসেই তিনি নাকি বদদোয়া দেবেন রুলস ভঙ্গকারী কে।

কোন মজারের গিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় পেছন দিক দেখানো যাবে না। উল্টো পথে সিঁড়ি বেয়ে কায়দা করে নামতে হয়।

এইসব কেচ্ছা প্রচন্ড শক্তিশালী কাহিনী ও প্রভাব আছে এলাকায়। যার সন্তান হয় না সে গিয়ে মানত করে, যার সন্তান আছে কিন্তু ছেলে সন্তান নেই, তা চাইতে মানত করে সেসব মাজারে।

যাহোক , আমার মফস্বলের সেই ছোট্ট মাজারের দরিদ্র খাদিম সেই ভিক্ষুকের মতন লোকটি আসা যাওয়ার পথে একদিন মোমবাতি কেনার জন্য দুটাকা চাইলো। আমি তাকে সরাসরি বলেছিলাম, দেখুন আপনাকে চা নাস্তা খেতে আমি বখশিশ দিতে পারি কিন্তু মাজারে মোমবাতির জন্য কোন টাকা দেব না। তিনি বললেন, স্যার এই প্রথম কেউ টাকা দিল না মাজারের জন্য। দুই টাকা হলেও মানুষ কিন্তু চাইলেই দেয়।

নিন চা নাস্তা খাবেন বলে পঞ্চাশ টাকা এগিয়ে দিতে তিনি সেটা নিলেন না। বললেন, টাকাটা তার জন্য নয়, দিলে মাজারের জন্যই দিতে হবে। আমি ভীষণ ফ্যাকড়ায় পড়ে গেলাম। জোর করলেও তিনি নিলেন না। তিনি আমাকে বললেন, স্যার শুনেছি আপনি অনেক বড় অফিসার। কিন্তু আপনার চেয়েও অনেক বড় অফিসার আমি চিনি যারা পাজেরো গাড়ি করে যাওয়ার সময়ও গাড়ি থামিয়ে মাজারের মোমবাতির জন্য টাকা দেন। তারা কেউ আপনার চেয়ে কম বিদ্বান নয়।

তার কথায় আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। নিজের মর্যাদা, জ্ঞান, ডিগ্রি নিয়ে একজন ফকিরের বক্তব্যে অসহায় তুচ্ছ বোধ করলাম। মাজারে শায়িত ওই ফকিরের একজন ভক্তের কাছে নিজেকে পরাজিত মনে হল।

সেদিন কিছুতেই তাকে টাকাটা দিতে পারলাম না। আমার অহংকারী মন ধুলোয় মিশে যাচ্ছিল। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না সে নিজের জন্য টাকা নেবে না। তার বিশ্বাস মাজারের জন্য ই সে বেঁচে আছে, কোন ডাক্তার বদ্যির সাহায্য ছাড়া সে সুস্থ্যভাবে বেঁচে আছে। তার বেশ ভূষায় দরিদ্রের ছাপ। কিন্তু তার বিশ্বাস ভয়ানক অটল পর্বতের মত। অনেক বড় মাজারের খাদেম কে দেখেছি টাকা বের করলে কেমন লোলুপ চোখে চেয়ে থাকে কিন্তু এই লোকের চোখে সেই দৃষ্টি নেই।

টাকাটা আবার মানিব্যাগে ঢুকাতে খারাপ লাগবে, তাই শেষবার অনুরোধ করলাম কিন্তু সে পেছন ফিরে হাঁটা ধরল মাজারের দিকে। মনে খুব কষ্ট নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরলাম, কাউকে কষ্ট দিতে চাইনি । আমাদের শিক্ষা যথেষ্ট উদার হয়নি, সেজন্য কখনো ফকিরের কাছে ও আমরা ইগোতে হেরে যাই।


ধন্যবাদ 

মন্তব্যসমূহ