রাশিয়ার ন্যাটোতে যোগ না দেয়ার কারন কী ?

নতুন বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো :

আজ রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন ন্যাটোর সদস্য হলে হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী হতো না। তেলের জন্য আমাদের দেশে এতো ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা লাগতো না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও আফগানিস্তান আগ্রাসনও সম্ভব হতোনা।  সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আগ্রাসনও সম্ভব হতোনা। কেন তা বলছি।

সোভিয়েত যুগ :

সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানিতে জার্মান নাতসী সামরিকবাদ পুনরুদ্ধারের আশংকায় ১৯৫৪ সালে ন্যাটোতে যোগদানের প্রস্তাব করে, কিন্তু এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য কর্তৃক প্রত্যাখ্যান হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের বার্লিন সম্মেলনের পর ন্যাটোতে যোগদানের জন্য সোভিয়েত অনুরোধ বিবেচনা করা হয়নি মূলত পেন্টাগনের নির্দেশে ।

যুক্তরাষ্ট্র এক ঘরে দুই পীরের অস্তিত্ব মানতে নারাজ। সে ন্যাটো নামক দুষ্টচক্রকে ব্যবহার করে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তখন থেকেই সচেষ্ট ছিল যা প্রমাণিত। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক, আফগান ও ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

রাশিয়ান যুগ :

১৯৯৭ সালের পর ন্যাটোর বিস্তার।  

ভ্লাদিমির পুতিন ২০০২ সালে রাশিয়ার ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন ।  তিনি চাননি  তার দেশকে ন্যাটোর স্বাভাবিক দীর্ঘ মেয়াদি আবেদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

২০০০ সালে পুতিন বলেছেন যে তিনি ক্লিনটনকে ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন! কিন্তু ওয়াশিংটনের 'সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা'র জন্য উত্তর মেলেনি। 


জর্জ রবার্টসন, একজন প্রতিরক্ষা সচিব যিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ন্যাটোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বলেছেন পুতিন তাদের প্রথম বৈঠকে এটি পরিষ্কার করেছিলেন যে তিনি রাশিয়াকে পশ্চিম ইউরোপের অংশ করতে চান।

২১ বছরেরও বেশি সময় আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবার অভিষিক্ত হওয়ার আগে পুতিন বিবিসি-র এক সাক্ষাৎকারে প্রয়াত ডেভিড ফ্রস্টকে যা বলেছিলেন "যদি এবং যখন রাশিয়ার মতামতকে ন্যাটোর অন্যান্য সদস্যের ন্যায় সমান অংশীদার হিসাবে বিবেচনা করা হবে " তবে তিনি  ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি পুনরায় ভেবে দেখবেন।

এটিই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আশার বাণী হতে পারত। আজ বিশ্ব নতুন একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হতে ৩০লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যে শরণার্থী হয়েছে  । এখন পুনরায় আরো একটি ভয়ংকর পারমানবিক যুদ্ধের পদ ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে বিশ্ব । কিন্তু তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কিবা যায় আসে। তারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা নিজেদের  মহাদেশের নিরাপদ  অবস্থান থেকে ভাবতে পারছে। তাই পুতিনের আশার বাণী অসার বাণীতে পরিণত হয়েছে।

পুতিন মনে করেন রাশিয়া ইউরোপীয় সংস্কৃতিরই অংশ। যাকে আমরা প্রায়শই সভ্য বিশ্ব ! বলে থাকি।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন আজ্ঞাবহ ইসরাইল ও ইউরোপিয়দের মত কুকুর, ভালুক নয়। আর তাই পুতিনের আবেদন ময়লার বাক্সে নিক্ষেপ করা হয়।

NATO + গঠন : 

যাহোক  পুতিন দূূধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চাইলেন। রাশিয়ার ইউরোপিয়ান হওয়ার ইচ্ছে থেকে রাশিয়া-ন্যাটো কাউন্সিল NRC, 2002 সালে তৈরি হয়। যার উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছে পুরন যেমন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, আফগানিস্তানে সহযোগিতা (অ-সামরিক আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহায়তা বাহিনী,  (আফগান যুদ্ধে ন্যাটোর রসদ টানা) এবং যুদ্ধের জন্য স্থানীয় ওষুধ উৎপাদন করা ।

কিন্তু ১ এপ্রিল ২০১৪-এ, রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ন্যাটো সর্বসম্মতিক্রমে রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে সমস্ত সহযোগিতা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

রাশিয়াকে ন্যাটোতে স্বাগত না জানালেও এস্তোনিয়া, আলবেনিয়া, লাটভিয়ার মত পুঁচকে দেশকে ঠিকই সদস্য করা হল।

NATO ও বাল্টিক রাষ্ট্র :

যেসব দেশ বাল্টিক সাগরের তীরে বাস করে , তাদের জন্য এর অপরিসীম গুরুত্ব স্বতঃস্ফূর্ত, কারণ এটি কার্যত একটি লাইফলাইন যা শিপিং রুটের কারণে দেশের রাজ্যগুলিকে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (ন্যাটো), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), হতে নিরপেক্ষ নর্ডিক রাজ্যগুলি (যেমন, সুইডেন) এবং এমনকি বেলারুশ সহ অন্যান্য বিভিন্ন দেশ বাফার স্টেট হিসেবে  রাশিয়া  রাজ্যগুলিকে ব্যবহার করে।
2002 সালে, বাল্টিক সরকারগুলি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান এবং ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। উক্ত দেশ তিনটি 2004-এ ন্যাটো সদস্য হয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করে।

লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়া - উত্তর-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত বাল্টিক দেশগুলি - এখন ইইউ এবং ন্যাটোর সদস্য। রাশিয়ার তাকিয়ে দেখা ছাড়া তখন কিছুই করার ছিল না। 

ইউক্রেন ও NATO :

ইউক্রেন কেন ন্যাটোতে যোগ দেয়নি?
২০১০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর ইউক্রেন ন্যাটো সদস্যতার পরিকল্পনা বাতিল করেছিল যেখানে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ, যিনি দেশকে জোট নিরপেক্ষ রাখতে পছন্দ করেছিলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

ইউক্রেনীয় দের একাংশ ইউরোপিয় হওয়ার আশায় "ইউরোমাইডান বিক্ষোভ" তৈরী করে ও সেই কারণে সৃষ্ট অস্থিরতার মধ্যে, ইয়ানুকোভিচ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে পালিয়ে যান।

ইউক্রেন ২০১০ সালে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করলেও কিন্তু তৎকালীন বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ের মত নিরপেক্ষ হিসেবে থাকতে চেয়েছিল। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইউনুকোভিচ ঐসব বাল্টিক দেশের মতো "no NATO but neutrality " নীতি বজায় রাখতে চাওয়ায় ইউক্রেনের জনগনের একটি বড় অংশের তোপের মুখে পড়েন ।

কিন্তু রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণ হওয়ায়, বাল্টিক রাষ্ট্রর্গুলোর ন্যাটোতে যোগদানের হিড়িক শুরু হয়েছে। এমন কি তুরস্কের চাহিদা মত দেশগুলো দীর্ঘদিন  কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দান থেকেও সরে আসে।

তাদের ঘোষণাটি ইউরোপীয় পরিবারের অংশ হওয়ার জন্য বাল্টিক রাষ্ট্রগুলির প্রচেষ্টা এবং ইচ্ছার প্রতীক।  ন্যাটোকে অনুচ্ছেদ ৫ এর অধীনে সুরক্ষা গ্যারান্টি সহ কেবলমাত্র সামরিক জোট হিসাবে নয়, বরং সভ্য বিশ্বের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে সে ঘোষণায় , যেখানে বাল্টিক রাজ্যগুলি তাদের উপযুক্ত স্থান খুঁজে পাবে বলে মনে করছে ।


ইউক্রেন ও ইউরোপিও ইউনিয়ন : 

ইউক্রেনের জনগনের একটি বড় অংশ ইউরোপের জাঁকজমকপূর্ণ জীবন দেখে একজন কমেডি অভিনেতা মার্কিন পন্থী জোলোনোভস্কি কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে।   এতে রাশিয়া নিজ দেশকে ন্যাটোর কামানের নিশানায় দেখতে পাচ্ছে । 

ইউক্রেনের রুশ বংশদ্ভূতরা জলনভস্কির কার্যক্রমের প্রতিবাদ করলে তিনি সঠিক পন্থায় তা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন। যার ফলে দেশের প্রতি সাধারণ জনগণের এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ কম । একজন রাষ্ট্রপতির নিরপেক্ষ রাস্ত্রনায়কচিত দূরদর্শিতার অভাবে আজ ইউক্রেনের মানুষ পারমানবিক হুমকির মুখে ।

সম্প্রতি অবধি, রাশিয়ান সরকার ন্যাটোতে বাল্টিক রাজ্যগুলির প্রস্তাবিত যোগদানের বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল এবং অনেক পশ্চিমা নেতা মস্কোর বিরোধিতা করতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

রাশিয়া কি বাল্টিক রাজ্যগুলিকে সংযুক্ত করতে চায়?

রাশিয়া বাল্টিক রাজ্যগুলিকে সংযুক্ত করার ইচ্ছা রাখে না, তবে এটি এখনও বিক্ষিপ্তভাবে তাদের স্বাধীনতার আইনি ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ২০১৫ সালে মস্কো ওসব দেশের প্রসিকিউটর অফিসের সিদ্ধান্তের বৈধতা পর্যালোচনা করার জন্য তিনটি দেশকে তাদের স্বাধীনতা "মঞ্জুর" করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিল।

পরোক্ষভাবে বললে, এই প্রশ্নের অন্তর্নিহিত উত্তর হলো রাশিয়াকে ন্যাটো জোটের সদস্য না করে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাস্ট্র গুলোকে সদস্যপদ দেয়ায়, রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদান নিয়ে পুতিন কর্তৃক বারংবার হুমকি দেয়া সত্বেও ইউক্রেনের সরকারের টনক না নড়ে উল্টো বিভিন্ন উস্কানি মূলক পদক্ষেপের প্রতিশোধ ই রাশিয়া নিচ্ছে। আজ রাশিয়া ন্যাটোর সদস্য হলে এমন অনেক যুদ্ধ এড়ানো যেত বিশ্বে । এর দায় যুক্তরাষ্ট্র এড়াতে পারেনা।

রাশিয়া ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর ন্যাটো যোগদানের প্রেক্ষাপট এক হলেও লক্ষ্য ভিন্ন।

রাশিয়া একটি বাল্টিক রাষ্ট্র হলে অন্য বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর মত তারও অধিক সুযোগ ছিল সদস্য হওয়ার। কেন ও কোন যুক্তির আলোকে রাশিয়া ন্যাটোর সদস্য হওয়া উচিত ছিল তার জন্য আপনার মন্তব্য সাদরে গৃহীত হবে।



মন্তব্যসমূহ