ডোডো পাখি কেন বিলুপ্তি হল !

ডোডো পাখি কারা মেরেছে!

ডোডো (Raphus cucullatus) একপ্রজাতির বিলুপ্ত উড্ডয়ন অক্ষম পাখি। পাখিটি ছিল মাদাগাস্কারের পূর্বে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত মরিশাস দ্বীপে স্থানিক প্রজাতি। জিনগতভাবে আরেক বিলুপ্ত প্রজাতি রড্রিগেজ সলিটেয়ার এর নিকটতম আত্মীয়। এ দুই প্রজাতি নিয়ে কলুম্বিডি গোত্রের অন্তর্গত র‍্যাফিনি উপগোত্রটি গঠিত। বর্তমানে জীবিত প্রজাতিগুলোর মধ্যে নিকোবর কবুতর ডোডোর নিকটতম আত্মীয়। একসময় ধারণা ছিল রেউনিওঁ দ্বীপে একটি সাদা ডোডো বাস করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ধারণাটি ভুল।
এই পাখি উড়তে পারতো না। ভালো সাতার কাটতে পারতো। এই পাখির মাংস ছিল সুস্বাদু। তবে কারও কারও মতে এ পাখি খেতে খুব একটা সুস্বাদু ছিল না। আকারে এই পাখি মুরগীর চেয়ে সামান্য বড় ছিল।



ডোডো পাখি কে মেরেছে? 

ডোডো ছিল খুবই বোকা গোছের পাখি। ডোডোকে প্রাকৃতিকভাবে কৌতূহলী, বন্ধুত্বপূর্ণ পাখি হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ রয়েছে ‘ডোডোর মতো মৃত্যু’ অর্থাৎ বোকার মতো মৃত্যু। এমন মৃত্যু যেটা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই ভিকটিমের। মানুষদের দেখে একদমই ভয় পেত না ডোডো পাখি, বরং আগ্রহী হয়ে মানুষের কাছে এসে ভিড়তো। তাই এরা মানুষের সহজ শিকারে পরিণত হয়। ডোডো পাখি ছিল যেকোন শিকারি প্রাণীর জন্য সহজ লক্ষ্য। মানুষ মরিশাসে কুকুর, বিড়াল, বানর, শুকর, ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী জাহাজে করে নিয়ে যায়। যার ফলে ডোডো পাখির পক্ষে এই দ্বীপের পরিবেশ টিকে থাকার জন্য একেবারেই অনুপযোগী হয়ে দাঁড়ায়। নিমিষেই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় পাখিটি।  
Image resultমরিশাস জাদুঘরে ডোডো পাখির কংকাল 

 


আসল খুনি ইউরোপীয় নাবিকরা। তারা  তাদের সাথে নাবিকদের আনা ইঁদুর, বিড়াল, শূকর এবং বানরের দ্বারা নিহত হয়েছিল। কিছু নাবিকরা খাদ্যে পরিবর্তনের জন্য পাখী টি কে টার্কি হিসেবে খেয়েছিল। অথবা ডোডোরা ক্ষুধার্ত হয়ে থাকতে পারে কারণ আক্রমণকারীরা ফলমূল সমৃদ্ধ বন পরিষ্কার করেছিল। বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের আচরণ পরিবর্তনের জটিল ঘটনার কারণে তাদের বিলুপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে।

মরিশাসে ডোডো পাখির একমাত্র শিকারি ছিল মানুষ। জার্মান সাম্রাজ্যবাদীদের খুব পছন্দের খাবার ছিল টার্কির মত দেখতে এই পাখি।

কোন শিকারি সেই দ্বীপে না থাকায় এরা পেঙ্গুইনের মত বেশি উড়ার কসরত করেনি । ফলে 1600–1662 সালের মধ্যেই জার্মান অভিবাসীরা এই পাখি সব খেয়ে শেষ করে ফেলে। মরিশাসে যখন ডোডো পাখী বিলুপ্ত হয়ে যায়, তখন বাবলা গাছের কিছু প্রজাতি পুরোপুরি পুনর্জন্ম বন্ধ করে দেয়। এর ফলে বাবলা গাছের ওই প্রজাতির অভাবে তার ফল, ফুলের উপর নির্ভরশীল পশুপাখির সংখ্যাও মারাত্মক কমে গেছে।

ডোডো পাখি এত বিখ্যাত কেন?


ডোডো অ্যালিসের অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের গল্পে তার ভূমিকা থেকে ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করেছিল এবং এটি তখন থেকে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, প্রায়শই বিলুপ্তি এবং অপ্রচলিততার প্রতীক হিসাবে।

যেমন বাঘ রক্ষা , এটি কেবল একটি সুন্দর প্রাণীকে বাঁচানো নয়। এটা নিশ্চিত করার জন্য যে আমরা একটু বেশি দিন বাঁচি কারণ বনগুলি আমাদের পরিবেশগত পরিষেবা দেয় যেমন পরিষ্কার বায়ু, জল, পরাগায়ন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি প্রদান করে। বন্য পাখি গ্রহের এইসকল বাস্তুতন্ত্রের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।এর ফলে পৃথিবীর কার্বনের পরিমান বেড়ে জলবায়ু উষ্ণ হয়েছে। এতে দেশে দেশে বন্যার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।ডোডো পাখির একমাত্র শিকারি ছিল মানুষ, তেমনি বাঘেরও একমাত্র শিকারি মানুষ।


ডোডো পাখির ইতিহাস 

১৫৯৮ সালে ওলন্দাজ অভিযাত্রী এডমিরাল উইব্রান্ড ভ্যান ওয়ারুইজকের মরিশাস অভিযানে প্রথম ডোডো পাখি সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে। তিনি এর নাম দেন ‘ওয়াগ্লভোগেন’ অর্থাৎ অভক্তিকর পাখি। এ পাখির মাংসের বাজে স্বাদের জন্যেই এমন নাম দিয়েছিলেন তারা। আর বলেছিলেন কালো বর্ণের পাখিগুলো দেখতে কবুতর ও ঘুঘুর মতো। কিন্তু আকৃতি ও ওজনে অনেক তফাত। এরা লম্বায় সাড়ে তিন ফুট ও ওজনে প্রায় ২০ কেজি।
গবেষণায় জানা যায়, ডিম থেকে বের হওয়ার পর ডোডো পাখি অতিদ্রুত প্রাপ্তবয়স্ক আকার ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা জানান, আগস্ট মাসে ডিম ফেটে এদের বাচ্চা বের হতো। এই সময়টাতে মরিশাস দ্বীপের গাছ বিভিন্ন রকম ফলমূলে ছেয়ে থাকে। ডোডো পাখির বাচ্চারা পেটুকের মতো এসব ফলমূল খেয়ে সাবার করে ফেলতো। এজন্যেই সচক্ষে ডোডো পাখির কর্মকাণ্ড দেখা অভিযাত্রীরা এ পাখিকে আখ্যায়িত করেছিলো পেটুক পাখি।
বর্ষাকালে ডিম থেকে বেরোনোর পর থেকেই অতিরিক্ত খাবার খেয়ে দ্রুত বড় হয়ে উঠতো পাখিগুলো। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অনেক রকম ঝড় ও দুর্যোগ আঘাত হানে মরিশাসে। এসময় দ্বীপে খাবারও থাকে না তেমন। এমন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে ডোডো পাখির এই দ্রুত বেড়ে ওঠা।
অতিদ্রুত প্রাপ্তবয়স্কের আকার ধারণ করলেও বংশ বৃদ্ধির জন্য ডোডো পাখিকে অপেক্ষা করতে হতো বেশ কয়েক বছর। মরিশাস দ্বীপে ডোডো পাখিকে খাওয়ার মতো তেমন কোনো শিকারি জন্তু-জানোয়ার ছিলো না। তাই নির্ভয়ে সময় নিয়ে বংশ বিস্তার করতো এরা।
গবেষকরা আরও জানান, ডিম পাড়ার পর ডোডো পাখির হাড়ে মিনারেলের পরিমাণ কমে যায়, যার ফলে পুরনো পালক ঝরে নতুন পালক জন্মায় এদের দেহে।
১৬শ শতাব্দীর নাবিকেরা বলেছিলেন এদের পালকের রং কালচে। এর কারণ সম্ভবত তারা নতুন পালক জন্মানো ডোডো পাখিই বেশি দেখতে পেয়েছিলেন। গবেষকরা জানান, জন্মের পর ডোডো পাখির পালক থাকে ধূসর-খয়েরি। ডিম পাড়ার মৌসুমে এই পালক ঝরে কালচে পালক জন্মায়।


গবেষকরা এটাও জানান, আজ থেকে ৩৫০ বছর আগে মরিশাস দ্বীপে মানুষ পৌঁছানোর মাত্র ১০০ বছরেরও কম সময়ে এই পাখি যেভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেল! মূলত মানুষই এই পাখি বিলুপ্তির প্রধান কারণ।
ডোডো পাখির শেষ দেখা মেলে ১৬৬২ সালেগবেষণার জন্য কোনো জীবিত ডোডো পাখির অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। তবে থেকে গেছে এর দেহাবশেষ। এই পাখির কংকাল সংরক্ষিত মরিশাসের জাদুঘরে।

বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ডোডো পাখির হাড় নিয়ে গবেষণা করে খুঁজে চলেছেন এই অসহায় পাখির অজানা কথা। চেষ্টা চালাচ্ছেন এদের সম্পর্কে আরো কিছু জানতে। দক্ষিণ আফ্রিকার ইউনিভার্সিটি অব কেপটাউনের এমনি এক গবেষণায় জানা যায়, এদের বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার সম্পর্কিত কিছু বিস্তারিত তথ্য।

আগেই বলা হয়েছে, এই পাখি খেতে ছিলো জঘণ্য। কিন্তু মরিশাস দ্বীপে খাদ্যের তেমন কোনো বিকল্প না থাকায় অভিযাত্রীরা বাধ্য হয়ে এদের খাওয়া শুরু করে। ডোডো পাখিরা মাটিতে বাসা বাঁধতো ও ডিম পাড়তো বলে সহজেই এদের ডিম চুরি করতো মানুষ। খাওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়াও ডোডো পাখি দেখলেই খেয়ালের বশে নির্বিচারে এদের হত্যা করতো অভিযাত্রীরা।

১৬শ শতাব্দীর শিল্পীদের তুলিতে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ডোডো পাখি

পাখিদের অত্যধিক ফসল কাটা, বাসস্থানের ক্ষতি এবং নতুন প্রবর্তিত প্রাণীদের সাথে একটি হেরে যাওয়া প্রতিযোগিতা, ডোডোদের বেঁচে থাকার জন্য খুব বেশি কষ্টকর  ছিল। শেষ ডোডো 1681 সালে নিহত হয়েছিল এবং প্রজাতিটি চিরতরে বিলুপ্তির পথে হারিয়ে গিয়েছিল। ডোডো ১৬শ শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক বিস্ময়কর পাখির নাম। এরা বসবাস করতো ভারত মহাসাগরের মরিশাস দ্বীপে। ওলন্দাজ নাবিকরা এই দ্বীপে পৌঁছানোর একশো বছরের মধ্যেই এরা বিলুপ্ত হয়। ফলে বিস্ময়কর এ পাখি সম্পর্কে অনেক কিছুই থেকে যায় মানুষের অজানা।

বর্তমানে গবেষকরা ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্র এক সুতোয় গেঁথে খুঁজে চলেছেন উড়তে অক্ষম এ পাখির হারিয়ে যাওয়ার রহস্য।

ডোডো পাখির কাল্পনিক চিত্র



বিলুপ্ত অন্যান্য  পাখিগুলো 



"বিলুপ্ত পাখি" বিষয়শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত নিবন্ধসমূহ
এই বিষয়শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত মোট ৫টি পাতার মধ্যে ৫টি পাতা নিচে দেখানো হল।

আর্জেন্টাভিস
এশীয় উটপাখি
চ্যাথাম পেঙ্গুইন
ডোডো
মোয়া (পাখি)















স্বাস্থ্যের কথা/ বাংলাভাষায় অনলাইন স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন

মন্তব্যসমূহ