দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে কি ভারত অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেতো?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে কি ভারত অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেতো?

ভেবে দেখুন, মাত্র ৫০ হাজার শ্বেতাঙ্গ সেনা ভারতবর্ষে মোতায়েন করে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষকে আড়াই শ বছর শাসন করেছিল। তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র ও কামান থাকলেও তাদের প্রকৃত অস্ত্র ছিল ভিন্ন।

ব্রিটিশরা মূলত ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ না হওয়ায় ভারতের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিটিশরা কিছু রাজ্যের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে এবং সাথে সামরিক ও বাণিজ্য জোট করেছিল। এই স্থানীয় ভারতীয় রাজকুমাররাই ব্রিটিশ শাসন বজায় রাখতে কার্যকর ছিল এবং ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত থেকে অনেক কিছু অর্জন করেছিল তারা।

ভারতে উপস্থিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সর্বদা ৭০% ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্য নিয়ে গঠিত ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব বা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এটি সত্য ছিল। এমনকি পলাশীর যুদ্ধেও ইংরেজদের ১০০০ সেনার সাথে ভারতীয় ২১০০ সেনা ছিল ( বলতে লজ্জা নেই, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ছিল ৫০,০০০ সেনা, যার অধিকাংশ যুদ্ধে দর্শক ছিল )।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্ররাষ্ট্রের অংশ হিসাবে ব্রিটিশ রাজ জার্মান অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ কমান্ডের অধীনে লড়াই করার জন্য পঁচিশ লক্ষ সৈন্য পাঠিয়েছিল যার বেশিরভাগ ভারতীয়। ৮৭০০০ এরও বেশি ভারতীয় সেনা (আধুনিক পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সহ) নিহত হয় বিশ্বযুদ্ধে। ব্রিটিশ ভারতের কমান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল স্যার ক্লোড অচিন্লেক বলেছিলেন যে,

যদি তারা ভারতীয় সেনা না পেত তবে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনটিই জিততে পারত না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি ভারতের স্বাধীনতার কারণ না হত তবে ব্রিটিশ উপনিবেশ এর আরো ৫৭ টি দেশকে ১৯৮১ সালের শেষ অবধি (নিউফাউন্ডলেন্ড শেষ উপনিবেশ) স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হতো না।

আমি সম্পূর্ণরূপে একমত, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না থাকলে ভারত কখনো স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না। কারন এই বিপুল ভারতীয় সেনা ব্রিটিশদের পক্ষে থাকলে নগন্য জন প্রতিরোধ খড়কুটোর মত উড়ে যেত।

আপনারা ভাবেন যে ভারতীয়রা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল, কিন্তু না। কিছু মুক্তিযোদ্ধা যারা যুদ্ধ করেছেন এবং মারা গেছেন যেমন, ভগত সিং, সূর্যসেন প্রমুখ। তবে তখনকার জনসংখ্যার কথা বিবেচনা করলে তা সামান্যই ছিল।

তবে আমরা সবাই জানি যে মানুষের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। 

মুঘলদের থেকে মুক্ত হয়ে ইংরেজদের অধীনে থাকাটাকে অনেক ভারতীয় স্বাধীনতা মনে করত। ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতার জন্য কেউ কেউ ব্রিটিশদের সহায়তা করতে চেয়েছিল। তারা বলেছিল, ‘আমরা যদি যুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের সহায়তা করি তবে ব্রিটিশদের হৃদয় গলে যাবে এবং আমাদের স্বাধীনতা দেওয়া হবে’। এই অনুভূতিটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও হয়েছিল কিন্তু স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতের মুসলিম সেনারা উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি না হওয়ায় তাদের রীতিমতো অত্যাচার করা হত।< /p>

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও ব্রিটিশদের সশস্ত্র বিভাগে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ নারী-পুরুষ সেনা ছিল। উপনিবেশিক অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষার জন্য সেনা মোতায়েনের কোন ঘাটতিও ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ সৈনিকরা দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক ছিল। সৈন্যদের দেশে ফিরে নিয়ে তাদের সেনাবাহিনীতে আস্তে আস্তে পরিণত করার কথা ছিল কিন্তু ব্রিটিশ সরকার আগ্রহী ছিল না । পরিবর্তে সৈন্যদের অভিযোগ সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ছিল। ব্রিটিশ সেনারা আর উপনিবেশে থাকতে রাজি ছিল না। কেবলমাত্র ভারতীয় সেনা দিয়ে শাসন চালানো অসম্ভব হত। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারিতে রয়্যাল এয়ার ফোর্স (আরএএফ) বিক্ষুব্ধ ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৬০ টিরও বেশি আরএএফ স্টেশনগুলিতে ৫০,০০০ এর বেশি ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রস্তুত রেখেছিল বিদ্রোহ দমন করতে।

সুতরাং ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে তার দীর্ঘ লালিত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না বলে মনে হয়। গান্ধী তাঁর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন , তিনি খুব কম কোনও উল্লেখযোগ্য ফল অর্জন করেছিলেন এবং ভারতকে ব্রিটিশ আধিপত্য থেকে মুক্ত করার জন্য বাধ্য করার মত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটেন আর্থিকভাবে ধসে পড়েছিল। তার উপনিবেশগুলি পরিচালনা করতে দৃঢ়তা ছিলনা। ১৯৪৫-৫১ এর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লেবারপার্টির ক্লিমেন্ট অ্যাটলি যিনি ভারতের স্বাধীনতা লাভে সহায়তা করেছিলেন তিনি দৃঢ়তার সাথে জানিয়েছিলেন যে গান্ধীর অসহযোগ এবং অহিংসতা আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের উপর শূন্য প্রভাব ফেলেছিল। সুভাস বোসের নৌ-বিদ্রোহ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ব্রিটিশ সরকারকে আতঙ্কিত করেছিল কিন্তু এর ফলে তারা ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার মত যথেষ্ট ছিলনা ।

একটি দেশ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে কল্পনা করুন এবং এখানে যুদ্ধে গণ-বিদ্রোহের পরিবর্তে শত্রুপক্ষেও লক্ষ লক্ষ দেশি সেনা রয়েছে । দৃশ্যটা কেমন হবে!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অনেক দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল কারণ ব্রিটেন তাদের দেশের দিকে মনোনিবেশ করতে চেয়েছিল । ভারতের মতো উপনিবেশগুলি রক্ষণাবেক্ষণ করা পাহাড়সম কষ্ট। ভারত থেকে প্রাপ্ত অর্থ ছিল তাদের সমস্ত প্রয়োজনের প্রধানতম। কিন্তু ব্রিটেন লিবিয়ার মতো অনেক আফ্রিকান উপনিবেশকে তাড়াহুড়ো করে বিশ্বযুদ্ধর পরে ছেড়ে যায়। ব্রিটিশরা ছেড়ে যাওয়ার পর (১৯৪৭ সালের পর) সেখানে কোনও সক্ষম সরকার বা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার স্থাপন না করেই চলছিল।

ব্রিটেন তখন ফ্রান্সের সাথে পুরো বিশ্বকে প্রায় নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু জার্মানরা ব্রিটিশ ও ফরাসিদের প্রতিরক্ষা এমন ভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল যে জেতার আশায় ছেড়ে দিয়েছিল তারা। ভারত, শ্রীলঙ্কা, বার্মা প্রভৃতি জায়গা থেকে দাস বা ভাড়াটে সেনা নিয়ে ব্রিটেন প্রতিরোধের চেষ্টায় ছিল।

শেষ পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতিরোধে জার্মানি হেরে গেল কিন্তু তারা এমন অসম্ভব কাজটি করেছিল যা কেউ করতে পারেনি বা স্বপ্নেও দেখে নি। তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ফরাসী সাম্রাজ্য বিনষ্ট করেছিল এবং প্রায় জিতেও গিয়েছিল।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্য ফ্রান্স ৬ সপ্তাহের মধ্যে জার্মানির হাতে পতন ঘটে এবং লন্ডন ও ম্যানচেস্টারের সব বস্ত্র কারখানা বোমায় উড়িয়ে দেয় জার্মানরা। পুরো উত্তর আফ্রিকাকে সুয়েজ খাল এবং মধ্য প্রাচ্যের তেল সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য মিত্র এবং অক্ষ শক্তির মধ্যে যুদ্ধ ওই অঞ্চলকে কুরুক্ষেত্রে পরিণত করেছিল।

ভেবে দেখুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে ব্রিটেনে রক্ষণশীল সরকারও থাকত না। ব্রিটেনের রক্ষণশীল টোরি পার্টির উইনস্টন চার্চিল যদি ১৯৪৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করত, তবে ১৯৪৭ সালেও ভারত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত না।

স্বাধীনতা প্রদানের প্রধান কারণ হ'ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছা ও ভারতে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে না পারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট অন্তত দুবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিকে ভারতের স্বাধীনতার বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের রেকর্ড তাই বলছে।

উপনিবেশগুলি কেবলমাত্র ব্রিটিশদের সম্পদ অর্জনের জন্য ছিল, তাদের এই লোভের ফলে ১৯৪৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, কুড়ি লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল। অথচ কোন রিলিফ পর্যন্ত ব্রিটিশরা দেয়নি (ডব্লিউ পি হান্টারের বই )। বাঙালিরা খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে অথচ সেবার জমির খাজনা ঠিকই আদায় হয়েছে (অমর্ত্য সেন)। উল্টো বাঙালিরা প্রতিবাদহীন জাতি বলে লজ্জা দেয়া হয়েছে , না খেয়ে মারা গেলেও বাঙালিরা নাকি রাজনৈতিক প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি।

তবে হ্যা, বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি ভারতীয় সেনা ছাড়া হয়ত জিততে পারত। তবে মিত্র শক্তি ভারতের কোষাগার ছাড়া জিততে পারত কিনা সন্দেহ।

ধন্যবাদ।

স্বাস্থ্যের কথা/ বাংলাভাষায় স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন

মন্তব্যসমূহ