আমেরিকা কেন সিরিয়া আক্রমণ করলো !

প্রায় আট বছর সিরিয়াতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে ২০২০ইং সালের জানুয়ারিতে সৈন্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিলো যুক্তরাষ্ট্র ।

আর খেলবেনা সেখানে, অনেক হয়েছে এবার ঘরে ফিরে যাবে, এমন একটা ভাব । সিরিয়ার বিদ্রোহী বাহিনী আর কুর্দিদের সঙ্গী করে যে মহৎ! উদ্দেশ্য নিয়ে সিরিয়া গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ২০০০ হাজার সেনা , সে উদ্দেশ্য থাক , এখন সময় থাকতে মান সম্মান নিয়ে ঘরে ফেরাটা কর্তব্য মনে করল পেন্টাগন।

কিন্তু ট্রাম্প এতদিনের সহযোদ্ধা কুর্দি বিদ্রোহী ও বিরোধীদের যে তোপের মুখে রেখে গেলেন, একে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত বলা চলে ।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়াতে হামলা করা কেন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কারন একটু খুঁজে দেখা যাক।

কি মহৎ উদ্দেশ্যে সিরিয়া গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র !


আরব বসন্তের পর, দুই বছর ধরে চলা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহী বিরোধী দল ও কুর্দিদের পেছন থেকে ব্যাপক সমর্থন সত্ত্বেও আসাদ সরকারকে সরানো যাচ্ছিলো না । তখন ২০১৩ আগস্টে পেন্টাগন সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ আনে । সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় জাতিসংঘের একটি তদন্ত দলকে যুক্তরাষ্ট্র পাঠায় ।

তার প্রেক্ষিতে ২০১৪ সেপ্টেম্বর এ যুক্তরাষ্ট্র ,ব্রিটেন ও ফ্রান্স সিরিয়ায় ১৭,০০০ স্থাপনায় একযোগে বিমান হামলা চালায় । সিরিয়া ধ্বংসস্তুপ এ পরিণত হলেও রাশিয়ান কমন্ডোদের ছত্রছায়ায় থাকায় আসাদ সরকারকে সরানো গেলো না । নতুবা বাশার আল আসাদের পরিণতি ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মতোই হতো আর সিরিয়া হত ইরাক।

কিন্তু রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন ইরাকে যে ভুল করেছিলেন, সিরিয়া বা ইরানে তার পুনরাবৃত্তি করতে চান নি । সেক্ষেত্রে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া ও চীনের পা ফেলার জায়গা থাকতো না। আন্তর্জাতিক যুদ্ধক্ষেত্রে চীন নির্বিকার থাকলেও রাশিয়া ও ইরান সিরিয়ায় সক্রিয় ছিল।

এতে এটা প্রমাণিত যে দুর্বল রাষ্ট্রের পক্ষে কোন পরাশক্তি থাকলে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের উপনিবেশবাদী ভূমিকা ব্যর্থ হতে বাধ্য ।


চিত্র, রাজধানী দামেস্কে আমেরিকার মিসাইল হামলা

সিরিয়ায় আমেরিকার প্রবেশ:


বাহির হতে সিরিয়ান বিদ্রোহীদের যথেষ্ট সাহায্যের পরও সফল হতে না পারায়, অতঃপর ২০১৫ তে যুক্তরাষ্ট্রের পদাতিক বাহিনী আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন উপেক্ষা করে সিরিয়ায় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করে যা মূলতঃ সামরিক আগ্রাসন । রাসায়নিক কারখানার যে অজুহাতে সিরিয়ায় আগ্রাসন চালায় যুক্তরাষ্ট্র, অনেক খুঁজেও কোন রাসায়নিক কারখানার সন্ধান মেলেনি ।

চিত্র, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ! 

ইতিমধ্যে সিরিয়ায় আইসিস এর উত্থান ও বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিদেশিদের জিম্মী করা ও হত্যার রাজনীতি শুরু হলো । ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র চিফ পেটি অফিসারকে হত্যা করে আইএস।

২০১৭ সালে পুনরায় রাশিয়া ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নার্ভ গ্যাস ব্যবহারের অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র ।

সেই উছিলায় রাশিয়ান স্থাপনা বাদ (ভয়ে!) দিয়ে আসাদ সরকারের বাসভবন, রাজধানী ও কেন্দ্রীয় শহর দুমা লক্ষ্য করে ৬০ টি ক্রুজ মিসাইল আক্রমণ করা হয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ২০১৭ তে । কিন্তু প্রেসিডেন্ট আসাদ টিকে যান রাশিয়ার স্থাপনায় আশ্রয় নিয়ে ।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হাল ছাড়েনি । ২০১৮ তে আমেরিকার মাস্টার সার্জেন্ট ও ব্রিটিশ আর্মি অফিসার সিরিয়ার হাতে নিহত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প আসাদকে পশু হিসেবে উল্লেখ করেন ও পুনরায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে তিন মিলিত শক্তি ব্রিটিশ ,ফ্রেঞ্চসহ এপ্রিলে শেষ চেষ্টা হিসেবে সিরিয়ার মূল সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ চালায় ।
তবে পেন্টাগন বলতে থাকে, সিরিয়ার মূল রাসায়নিক কারখানা টি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে এবং সেটি পুনর্গঠন করা কঠিন ।
চিত্র, কথিত রাসায়নিক কারখানা, যা বাস্তবে ছিল একটি গুঁড়ো দুধ কারখানা ।

রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স:

চিত্র, এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা


বাস্তবে রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ব্যবহার করে সিরিয়া সব ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে ঠেকিয়ে দেয় ।

সম্ভবত এটাই রাশিয়ার সেই উন্নত এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা । এই বিমান প্রতিরক্ষার জন্য তুরস্ক, ভারত ও আরো কিছু দেশ ইতিমধ্যে অগ্রিম পরিশোধ করেছে ।

ট্রাম্প রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন কে একজন পশুকে সমর্থন করার ও তার পাশে দাঁড়ানোর অভিযোগ করেন । কিন্তু পুতিন উল্টো আমেরিকার এই আক্রমণকে আগ্রাসন হিসেবে উল্লেখ করেন ।

রাশিয়া এই হুমকিও দিয়ে রাখে সিরিয়ায় আর কোন মিসাইল হামলা হলে, পাল্টা আক্রমণ করার । হতাশ  জেমস ম্যাটিস, মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সিরিয়ায় রাশিয়ার কার্যকলাপের নিন্দা করলে, রাশিয়া কড়া ঘোষণা করে সিরিয়ার আকাশে যে কোন বিমান উড়তে দেখলে তাকে ভূপাতিত করা হবে । এতে ট্রাম্প কিছুটা দমে যান ।

রাশিয়ার বিমান হামলায় আইএস যোদ্ধাদের ট্রেড মার্ক কালো ড্রেস বদলে সাদা কাফনের পোশাকে পরিণত হয় । বিমান হামলায় আইএস এর দখল করা শহরগুলো লাশের স্তুপে পরিণত হয় । এতদিন যুক্তরাষ্ট্র আইএস এর মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযোগে সিরিয়ায় প্রবেশের বাড়তি অজুহাত দেখালেও করলেও বাস্তবে তারা আইএস কে আক্রমন না করে আসাদ সরকারকে উৎক্ষাতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু সিরিয়ায় আইএস এর ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করেছিল প্রকৃত পক্ষে রাশিয়ান বিমান বাহিনী।

সিরিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা :

তুরস্কের মূল আগ্রহ কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকার দখল বজায় রাখা । 
তুরস্ক ২০১১ সাল থেকে আসাদ বিরোধীদের সমর্থন করে ও আসাদ সরকারের পদত্যাগের পরামর্শ দেয় । ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামক বিরোধী দলকে অস্ত্র ও দেয়। কিন্তু সিরিয়া ও রাশিয়ার ক্রমাগত আক্রমণে তুরস্ক সাফল্য পায়না । এরদোগান , সীমান্তে আই এস ও কুর্দিদের কার্যকলাপের অজুহাতে নিজে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে পাল্টা আক্রমণ করেন। এতে মার্কিনিদের সহযোদ্ধা কুর্দিরা ব্যাপক ধ্বংসের মুখে পড়ে । তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয় এরদোগান । আইসিস ও তুর্কি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় । কিন্তু যুদ্ধের শেষদিকে রাশিয়া ও সিরিয়ার বিমান হামলায় তুরস্কের ব্যাপক ক্ষতি হয় ।

ট্রাম্পের পশ্চাৎপসরণ :


চিত্র, আমেরিকান সেনাদের ফেরত যাওয়া শুরু


রাশিয়া কর্তৃক সিরিয়ার আকাশে যে কোন বিদেশী সামরিক বিমান ভুপাতিত করার ঘোষণায়, যুক্তরাষ্ট্র হতাশ হয়। 

তারই প্রেক্ষিতে ২০১৯ এর জানুয়ারি ট্রাম্পের ঘোষণা এলো সিরিয়া থেকে সরে যাওয়ার । যাওয়ার আগে ট্রাম্প সিরিয়ার কুর্দিদের রক্ষার জন্য সেই এরদোগান এর সাথেই গোপন চুক্তি করে যায় (নতুবা আসাদ সরকার কুর্দিদের কচুকাটা করে ছাড়ত) । রাশিয়ান বাহিনীর হাতে ব্যাপক মার খাওয়ার পর তুরস্ক এক সময় সিরিয়া হতে সরে আসে।



সবশেষে, সিরিয়া মুক্ত হলেও কতদিন এমন মুক্ত থাকবে বলে কঠিন ।
২০১১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল মিলে সিরিয়াকে দখল করতে অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে । তারা ব্রিটেন ও ফ্রান্সকেও মধ্যপ্রাচ্যের দখল নিতে আক্রমণে এনেছে । কিন্তু এক ভ্লাদিমির পুতিনের জুডোর চালে যুক্তরাষ্ট্র কুপোকাত হয় ।

আর এই পুতিনকে এই লড়াইয়ে শামিল করেছিলো ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানি । তাঁকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় পরাজয়ের কিছুটা জ্বালা কমিয়েছে মাত্র ।



মাটনের ইতিবৃত্ত জানতে লিংকটি দেখা যেতে পারে। 


স্বাস্থ্যের কথা/ বাংলাভাষায় অনলাইন স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন

মন্তব্যসমূহ