জিনোম সিকোয়েন্স কী

জিনোম সিকোয়েন্স

যে ভয়াবহ দৈত্য সরি, জীবাণু ইতিমধ্যে ২ লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করে এখনো ধংস যজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, তার জিনের গাঠনিক বিন্যাস উন্মোচিত হয়েছে বাংলাদেশে । চাইল্ড হেলথ কেয়ার ফাউন্ডেশন এর ড. সমীর ও সেঁজুতি সাহা এই পিতা কন্যার যৌথ প্রচেষ্টায় বিশাল এই কাজটি বাংলাদেশ এর করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা ও গবেষণায় সহায়তা করবে।

২৯ জানুয়ারি ২০২০, ফ্রান্সের পাস্তুর ইনস্টিটিউট নভেল করোনাভাইরাস এর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স করে এবং এটা প্রথম করার দাবিদার।


আমরা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে $১,০০০-এর কম খরচে একটি সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকোয়েন্স করতে পারি। এটি একটি দুর্দান্ত খবর - এবং বরং বিস্ময়কর, যেহেতু প্রথম মানব জিনোম ক্রম (২০০৩ সালে সমাপ্ত) আনুমানিক $৪০০,০০০,০০০ খরচ হয়েছে! এর মানে কি আমরা প্রতিটি ব্যক্তির অনন্য জেনেটিক ব্লুপ্রিন্ট ব্যবহার করতে সক্ষম হব তার স্বাস্থ্যসেবাকে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত পরিচালনা করতে? হয়তো শেষ পর্যন্ত, তবে এটি যতটা সহজ মনে হচ্ছে ততটা সহজ নয়।



জিন সিকোয়েন্স কি ?

সহজ কথায় বললে, এটা মানুষের জিন মানচিত্র। ২০০০ সালে প্রথম মানুষের পূর্ণাঙ্গ জিন মানচিত্র উদ্ঘাটন করে যুক্তরাষ্ট্র, তখন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন উচ্ছ্বাস করে বলেছিলেন, ‘আমরা এখন সেই ভাষা শিখে ফেলেছি, যে ভাষা দিয়ে ঈশ্বর আমাদের তৈরি করেছেন।’ প্রায় ১০ বৎসর লেগেছিলো বিজ্ঞানীদের মানবজিনোম নকশা উদ্ভাবন করতে। জিন সিকোয়েন্স বুঝতে এর গঠন নিয়ে ছোট আলোচনা করছি।

জিন:

জিন গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘কোনো কিছু থেকে উদ্ভূত হওয়া’ । একটি বিস্তৃত ডিএনএ অণুর নির্দিষ্ট খণ্ডাংশ, যা জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে তাকে জিন বলে।

জেনম

একটি জীব এর জিনোম বলতে তার সম্পূর্ণ বংশগতির তথ্য, যা কিনা তার DNA (অথবা কিছু ভাইরাসের জন্যে RNA)-তে ধারণ করা থাকে, তাকে বোঝায়।

জিনোটাইপিং

জিনোটাইপিং হল একজন ব্যক্তির কোন জিনগত বৈচিত্র রয়েছে তা নির্ধারণ করার প্রক্রিয়া।

ফেনোটাইপিং

ফেনোটাইপিং হলো পরিচিত একটি কৌশল, বিজ্ঞানীরা কেবলমাত্র কারো ডিএনএর উপর ভিত্তি করে ঐ ব্যক্তির শারীরিক চেহারা নির্ধারণ করতে সক্ষম হন।

সিকোয়েন্সিং

সিকোয়েন্সিং হল একটি পদ্ধতি যা ডিএনএর একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের সঠিক ক্রম নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।

জিনোম সিকোয়েন্স

ভাষাশিক্ষার জন্য আমাদের যেমন অ, আ, ক, খ, ইত্যাদি বর্ণমালা আছে, জীবের গঠন ও বংশগতির জন্য তার জিনেও তেমনি A ,T, G, C নামক অনু থাকে । বইয়ের পৃষ্ঠায় যেমন বর্নগুলো লিখিত হয়, তেমনি সুগার-ফসফেট বন্ড নামক হেলিক্স এ ডিএনএ অণুগুলো গেঁথে থাকে।

চিত্র, ডিএনএ এর গঠন। A এডেনিন, T থায়মিন, G গুয়ানীন ও C সাইটোসিন চারটি অনু সুগার ফসফেট হেলিক্স এ সংযুক্ত। পাশাপাশি দুটো অনু বেস প্যায়ার বা জোড়াভিত্তির গঠন ।

DNA-এর বর্ণমালা এই চারটিই। A, T-এর সঙ্গে আর G, C-এর সঙ্গে বন্ধনীর মাধ্যম এ যুক্ত হয়ে বেস পেয়ার (base pair) তৈরি করে। তবে RNA -এর বর্ণমালা A, U, G এবং C। RNA-তে T-এর পরিবর্তে U বর্ণমালাটি ব্যবহৃত হয়।

জিনগুলো সজ্জিত থাকে ক্রমোসোমে। তারা পাশাপাশি থাকতে পারে বা তথ্যবিহীন অংশ দিয়ে পৃথক হয়ে দূরে দূরেও থাকতে পারে। জিন নির্ধারণ করে জীবের বৈশিষ্ট্য। যেমন চুলের রং, চোখের রং প্রভৃতি।

জিনোমের আকৃতি বেস পেয়ার হিসেবে মাপা হয়, আর তা বিভিন্ন জীবের জন্যে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন, মানুষের জিনোম সাইজ হলো ৩ বিলিয়ন বেস পেয়ার ও জিনের সংখ্যা ৩০ হাজার ।করোনা' র জিনোম সিকোয়েন্স করে জানা যায় , এটি একটি এক সূত্রক পজিটিভ RNA , যা কিনা ৩০০০ বেস পেয়ার আর জিনের সংখ্যা মাত্র ১৫ টি।

মাত্র ১৫ টি জিন সম্পন্ন করোনা জীবাণু কিভাবে ৩০ হাজার জিন সম্পন্ন মানুষকে ধ্বংস করে চলেছে , তা রহস্যময় ।

করোনা কিন্তু নতুন কোন ভাইরাস নয়, এর অস্তিত্ব ছিলই । শুধু বদলে গেছে এর জিনের গঠন। ক্ষুদ্র শরীরে একের পর এক রাসায়নিক বদল ঘটিয়ে সে এখন অপ্রতিরোধ্য ।

জিনোমকে যদি A, T, G, C বর্ণমালা দিয়ে প্রকাশ করা হয় তাহলে সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স(whole genome sequence) হলো পাশাপাশি রাখা অসংখ্য বর্ণমালা। যেমন , ATGCGACT,,,.

অর্থাৎ জিনোম সিকোয়েন্স হলো কোষের সম্পূর্ণ ডিএনএ বিন্যাসের ক্রম।




সিস্টিক ফাইব্রোসিস রোগ সৃষ্টিকারী জিনটি ৪,৪৪০টি রাসায়নিক অক্ষর দিয়ে তৈরি, যা ১,৪৮০টি অ্যামিনো অ্যাসিড সহ একটি প্রোটিনকে এনকোড করে। এই জিনের একটি দুর্বল অংশে মাত্র একটি অক্ষরের পরিবর্তন - যাকে "পয়েন্ট মিউটেশন" বলা হয় - এমন একটি প্রোটিন তৈরি করতে পারে যা জটিল মাল্টিসিস্টেম ডিসঅর্ডারের দিকে পরিচালিত করে যাকে আমরা সিস্টিক ফাইব্রোসিস বলি। বিপরীতে, একই জিনের বিভিন্ন অংশে একক অক্ষর পরিবর্তনের কারণে অল্প বা কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে।


সিস্টিক ফাইব্রোসিস (সিএফ) একটি জেনেটিক (উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত) রোগ যা ফুসফুস এবং অগ্ন্যাশয় সহ অঙ্গগুলিতে আঠালো, ঘন শ্লেষ্মা তৈরি করে। যাদের সিএফ আছে তাদের ক্ষেত্রে ঘন শ্লেষ্মা শ্বাসনালীকে আটকে রাখে এবং শ্বাস নিতে কষ্ট করে। ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে ফুসফুস পরিষ্কার করার উপায় এবং সঠিকভাবে খাওয়া।




সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং:

রোগ সনাক্তকরণ, চিকিত্সা এবং প্রতিরোধের জন্য আরও ব্যক্তিগতকৃত কৌশল বিকাশের জন্য আপনার জিনোম ব্যবহার করার আগে, এমন অনেক বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হতে হবে যা আপনার জিনোমকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তোলে। যদিও এই বৈচিত্রগুলির বেশিরভাগই খারাপ বা ভাল নয়, কিছু কিছু নির্দিষ্ট রোগের ঝুঁকি বাড়ায় এবং অন্যরা ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। আমরা কিভাবে বুঝতে পারি কোনটি কোনটি?


এই পরীক্ষাগুলি জেনেটিক বৈচিত্র খুঁজে পেতে একজন ব্যক্তির ডিএনএর বেশিরভাগ অংশ বিশ্লেষণ করে। সম্পূর্ণ এক্সোম বা সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং সাধারণত ব্যবহার করা হয় যখন একক জিন বা প্যানেল টেস্টিং একটি রোগ নির্ণয় প্রদান করে না বা যখন সন্দেহজনক অবস্থা বা জেনেটিক কারণ অস্পষ্ট হয়। পুরো জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রায়ই একাধিক একক জিন বা প্যানেল পরীক্ষার চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল এবং সময়-সাপেক্ষ।

সম্পূর্ণ-জিনোম সিকোয়েন্সিং (WGS) সম্পূর্ণ জিনোম বিশ্লেষণের জন্য একটি ব্যাপক পদ্ধতি।  জিনোমিক তথ্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্যাধি শনাক্ত করতে, ক্যান্সারের অগ্রগতির দিকে পরিচালিত করে এমন মিউটেশনের বৈশিষ্ট্য এবং রোগের প্রাদুর্ভাব ট্র্যাক করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।

একজনের জিনোম সিকোয়েন্স করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যতের যত্নের জন্য চিকিৎসা মূল্যের তথ্য প্রাপ্ত করা।  জিনোমিক সিকোয়েন্সিং জেনেটিক ভেরিয়েন্টের তথ্য প্রদান করতে পারে যা রোগের কারণ হতে পারে বা রোগের বিকাশের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, এমনকি উপসর্গবিহীন ব্যক্তিদের মধ্যেও।

জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা আছে।  এটি আজীবন ব্যবহার করা যায় এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ক্যাসকেড পরীক্ষা করা যায়। ক্লায়েন্টের পরিবারে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মূল্যবান তথ্য দেয়। 


মানুষের জিনোম হল হোমো সেপিয়েন্সের জিনোম।  এটি ২৩টি ক্রোমোজোম জোড়া নিয়ে গঠিত যার মোট প্রায় ৩ বিলিয়ন ডিএনএ বেস পেয়ার বা জোড়া রয়েছে।

WGS সাধারণত ছয়টি ধাপ নিয়ে গঠিত। 

একটি জিন একটি প্রোটিনের কোড করার জন্য যথেষ্ট ডিএনএ নিয়ে গঠিত এবং একটি জিনোম হল একটি জীবের ডিএনএর মোট যোগফল।  ডিএনএ লম্বা এবং ক্ষীণ, এটি ক্রোমোজোমে প্রবেশ করলে সার্কাস পারফর্মারের মতো বিচ্ছিন্ন হতে সক্ষম।


একটি মানব জিনোম প্রায় এক দিনের মধ্যে ক্রম করা যেতে পারে, যদিও বিশ্লেষণটি অনেক বেশি সময় নেয়।  ডিএনএ সিকোয়েন্সিং মেশিন এক সাথে পুরো জিনোম সিকোয়েন্স করতে পারে না।


জিনোম সিক্যুয়েন্সিং এর প্রয়োজনীয়তা:

সাধারণ ফ্লু যখন মহামারী হয় তার মধ্যে এক আধটা ভাইরাল প্রোটিনের বদল ঘটে, যাকে বলে ‘পয়েন্ট মিউটেশন’ (Point Mutation) । অর্থাৎ এক বা সিঙ্গল অ্যামাইনো অ্যাসিডের বদল। কিন্তু করোনার মধ্যে সেই পরিবর্তন লাগামছাড়া।

যে কোনও সাধারণ ভাইরাস ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে যদি তার ভিতরে একাধিক মিউটেশন (Genetic Mutation) হয়। ফ্লু-এর ভাইরাসও তখন হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী। তেমনই পরিবর্তন চলছে করোনাভাইরাসের । বারবার সে নিজেকে বদলে ফেলছে । এ পর্যন্ত নভেল করোনা ভাইরাস ৩৮০ বার মিউটেশন অর্থাৎ জিনের গঠন বদলেছে।

এই ‘পরিবর্তিত’ ভাইরাসকে রোখার জন্য তার দুর্বলতা খুঁজতে হবে। জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষকদের সেখানে সাহায্য করবে।

কারণ যে ওষুধ বা ভ্যাকসিনই দেওয়া হোক না কেন, ভাইরাস তার ধরন বদলে ফেললে সেই ভ্যাকসিন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।

দেহের প্রতিরোধ গঠন, ভ্যাক্সিন তৈরি ও জেনম সিকোয়েন্স এরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ।

জিনোম সিকোয়েন্সিং এর উপকারিতা:

১) রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করে রোগ নির্ণয়কারী kit তৈরি সম্ভব, ২) প্রতিষেধক ড্রাগ ও ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব,

৩) জীবাণুর সেরোটাইপ (serotype ) করা সম্ভব,

৪) জীবাণুর উৎস সম্পর্কে তথ্য জানা সম্ভব,

৫) জিনোম অ্যাসোসিয়েশন স্টাডি করে ব্যক্তির জন্যে নির্দিষ্ট ওষুধ (customized medicine) দেওয়া সম্ভব,

৬) স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির জিনোম সিকোয়েন্সিং করে জানা সম্ভব কোন বয়সে তিনি কোনও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন, জেনেটিক ভেরিয়েশনের কারণে কখন তার ক্যানসার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ সৃষ্টি হতে পারে।

সূত্রঃ

জিনোমনিউজনেটওয়ার্ক ডট ওআরজি

করোনা ৩৮০ বার জিনের গঠন বদলেছে, মানুষের শরীরে খুঁজে পেয়েছে বন্ধু জিন, কোভিড রহস্য জানালেন বাঙালি বিজ্ঞানী - TheWall






ধন্যবাদ পড়ার জন্য। স্বাস্থ্যের কথা/ অনলাইন স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন

মন্তব্যসমূহ