কচু ও তার পুষ্টি পরিচিতি

কচু নিয়ে কিছু কথা, কচু ও তার পুষ্টি পরিচিতি
জীববৈচিত্রের অপরূপ বৈচিত্র রয়েছে এ পৃথিবীতে। সৃষ্টি কর্তার রহস্যের মাঝে সকল সৃষ্টি মানুষের কল্যাণে প্রতিফলিত হয়। বাহারি রকমের শাক সবজির মধ্যে আবহমানকাল থেকেই কচু বেশ জনপ্রিয়। তারপরও কচু সবচেয়ে অবহেলিত উদ্ভিদ।  অবহেলিত এই অর্থে, কোন রকম যত্ন আত্তি ছাড়াই একটু পানি আর স্যাঁতস্যাঁতে মাটি পেলেই সে জন্মাবে। এর পুষ্টিগুণ জগৎ বিখ্যাত। 

কিছু কচুপাতা দেখতে অদ্ভুত বা রঙিন বলে সেগুলো বাগানে, ব্যালকোনিতে পাতাবাহার হিসেবেও স্থান পায়। কিন্তু সেসব পাতা বাহার কচু সুন্দর হলেও স্বাস্থ্যকর নয়।

ভেবে দেখুন, কচু খেয়ে গলা ধরে, চুলকায়,  বলে গরু ছাগল সেটি খায় না। এটি বিবর্তনের ইতিহাসে প্রকৃতিতে কচু গাছের টিকে থাকার রহস্য।

কচুর পরিচয়


বনে জঙ্গলে যেসব কচু আপনা আপনি জন্মায় সেগুলকে সাধারণত “বুনো কচু” বলে । এ ধরনের কচুর অনেকগুলো জাত মানুষের খাবারের উপযোগী নয়।
কচু Araceae গোত্রভূক্ত একধরনের কন্দ জাতীয় ফসল। এর ইংরেজি হলো Taro এবং কচুগাছের ইংরেজি হলো Taro tree। ধারণা করা হয় কচুগাছের আদি নিবাস ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। প্রায় দু হাজার বছর আগেও কচু চাষ করা হতো।
বনে জঙ্গলে যেসব কচু আপনা আপনি জন্মায় সেগুলকে সাধারণত “বুনো কচু” বলে । এ ধরনের কচুর অনেকগুলো জাত মানুষের খাবারের উপযোগী নয়। নাইজেরিয়া বিশ্বের বৃহত্তম কচু উৎপাদনকারী দেশ।

সবজি হিসেবে কচু 

সবজি হিসেবে কচু আমার মতো অনেকের প্রিয় খাবার। কচুর প্রায় সব কিছুই খাওয়া যায়, কচু শাক, কচুর গোড়া, লতি, কচুর গাট বা কচুর মুখি অথবা কচুর ফুল।
কচুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রনক্যালসিয়াম যা আমাদের হাড় শক্ত করতে সহায়তা করে। চুলের ভঙ্গুরতাও বন্ধতেও কচুর উপকারিতা অনেক। কচুতে আয়োডিনের পরিমাণও অনেক। যাদের গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটি রয়েছে তাদের জন্য কচু অনেক উপকারী। কচুর লতিতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরাও নিশ্চিন্তে খেতে পারেন এটি।

কচুশাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'এ' থাকায় রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এটি  উপকারী।


কচুর এন্টি নিউট্রায়েন্ট উপাদান 

অনেকেই মনে করেন কচু খাওয়া বেশ ঝামেলার কাজ। কারো গলায় ধরে, কারো গলা চুলকায়। খুব সস্তা হলেও অনেকে অন্য সব সবজি খেলেও কচু এড়িয়ে চলেন অবজ্ঞা ভরে ।

কচুতে আছে অক্সলেট নামক উপাদান।  কচু শাক ধরলে বা কচু খেলে অনেক সময় গলা চুলকায়। তাই কচু রান্না করার সময় লেবুর রস বা সিরকা ব্যবহার করা উচিত। তবে যাদের শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের কচু না খাওয়াই ভালো। কচু খেলে শরীর পুষ্ট হয় এবং শুক্র বৃদ্ধি পায়। কান ও গলার রুক্ষতা বা সুড়সুড়ি দূর করে। এটি আমাশয় রোগে বিশেষ উপকারী।

কচুর জাত 

খাবার উপযোগী কচুর জাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে,

১, মুখীকচু,

মুখী কচু। কচুগাছের মূলেই আসলে কচু থাকে। এটাকে সাধারণত কচু মুখী বা মুখী কচু বলা হয়ে থাকে।
এটি খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণ শ্বেতসার, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস এবং ভিটামিন এ ও সি আছে ।
মুখীকচুর স্টার্চের হজম হয় বেশী বিধায় এর স্টার্চ শিশু খাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মুখীকচু ক্ষারজাতীয় খাদ্য বিধায় অম্ল বা এসিডিটিতে এটি উপকারী। এটি খরা মৌসুমে সবজির অভাব পূরণে সাহায্য করে।

২, পানিকচু,

সাধারণত যে কচু স্বল্প পানিতে চাষ করা যায় তাকে পানিকচু বলা হয়। আমাদের দেশে স্থান ভেদে পানিকচুর নাম ভিন্ন যেমন নারকেলি কচু, শোলা কচু, জাত কচু, বাঁশকচু, কাঠকচু ইত্যাদি। তবে পানি কচু নামেই সর্বাধিক পরিচিত। পানিকচুর লতি ও কাণ্ড সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্ষার শেষে যখন বাজারে সবজির ঘাটতি দেখা দেয় তখন জুন-সেপ্টেম্বর মাসের বাজারে পানি কচুর লতি ও কান্ড বেশ জনপ্রিয়।


৫, ওলকচু,

বুনো ওল।
“যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেতুল” প্রবাদটার সাথে সাথে বাংলাদেশের বুনো ওলের জাতটা হারিয়ে যেতে বসেছে। এর চুলকানী গুনের আড়ালে যে দেশি ও খাটি স্বাদ লুকিয়ে আছে তা সকলে আবিষ্কার করতে পারলো না।
যাই হোক, দেশি ওলের পরিবর্তে বিদেশী ওল দখল করে নিয়েছে বাজারের একটি বড় অংশ। জায়গা করে নিয়েছে কৃষকের মন। কারন বিদেশি ওল কচু চাষ আজ বানিজ্যিকভাবে লাভজনক।
বহু কৃষককের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছে এই ওল। আর তা ঘুরাবেই না কেনো, পোকা-মাকড়ের বালাই নাই, রোগ-বালাই কম এমন কি ছাগলেও এ গাছ খায় না। পরিত্যাক্ত আধা ছায়া জায়গাতেও এটি হয়, (অবশ্য রোদ্রে ফলন ভালো হয়।) এক কথাই রিস্ক বা ধরা খাওয়ার কোনো উপায় নাই। তবে কৃষক যদি নিতান্তই অলস হয়, তাহলে তার কথা বলতে পারছি না। যারা কৃষিকাজে নতুন আসছেন, তাদের জন্য ওল চাষ নিরাপদ।
এটি ২৫ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত ওজনের হয়। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস এবং বিটা ক্যারোটিন বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এগুলি ছাড়াও এতে প্রচুর ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে যা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। ওলে প্রচুর পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালোরি, ফ্যাট, কার্বস, প্রোটিন, পটাসিয়াম, দ্রবণীয় ফাইবার পাশাপাশি ভিটামিন বি 6, ভিটামিন বি 1, রাইবোফ্লাভিন, ফলিক অ্যাসিড, নিয়াসিন ইত্যাদি জাতীয় পুষ্টি রয়েছে এ ছাড়া ভিটামিন এ, বিটা ক্যারোটিন জাতীয় পুষ্টি পাওয়া যায় যা শরীরকে রোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।

৭, মানকচু,

মানকচু কচু পরিবারের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, নিউ গিনি এবং কুইন্সল্যান্ড দ্বীপের অরণ্য মানকচুর আদি জন্মস্থান। এটি দীর্ঘকাল ধরে ফিলিপাইন, বিভিন্ন প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ এবং অন্যান্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে। বাংলায় এটি মানকচু নামেই বহুল পরিচিত।
গ্রামীণ জনগোষ্ঠী কচিপাতা, পাতার ডাটা এবং করম বা কন্দ সবজি হিসেবে এবং ওষুধ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে যা বিভিন্ন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি যেমন- দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্ভিক্ষ, খরা, লবনাক্ততা, দারিদ্র্য বিমোচন ও জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।

মানকচু এর মাংসল সাদা অংশ সু-স্বাদু তবে কাঁচা খাওয়া যায় না। সামন্য গলা চুলকায়। রান্না বা খাওয়ার জন্য গরম পানিতে ফুটিয়ে নিতে হয়।

বাড়ির আশপাশে পতিত জমি ইত্যাদিতে চাষ করা যায় ফলে অন্যান্য ফসলের সাথে প্রতিযোগী নয়। আন্তঃফসল হিসেবে চাষ করা যায় এবং তেমন যত্ন নিতে হয় না বিধায় এর উৎপাদন খরচ খুবই কম এবং সারা বছরই কচি পাতা, ডাটা সবজি হিসেবে সংগ্রহ করা যায়।

মানকচু বিশেষ করে এশিয়ান অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ অপ্রচলিত ফসল এবং পুষ্টি ও ঔষধি গুণ বিশিষ্ট ফসল। এটি এন্টি-ফাঙ্গাল, এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল, এন্টি-রিওমাটিজম, ক্যান্সার প্রতিরোধী, এন্টি-ইনফ্লামেটরি ইত্যাদি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিগুণ: ভিটামিন এ, বি, সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম এবং এন্টি অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ।


কচু ফুল 

গ্রামে প্রচলিত কথা, রান্নার কিছু না থাকলে কচুর ফুলের শাক রান্না করলেই চলবে পারলে সাথে একটু ডাল। এখন নতুন প্রজন্মের অনেকেই কচুর ফুলের শাক চিনে না। গ্রামবাংলার প্রত্যেক মানুষ এই শাক বেশি পছন্দ করে কারণ এই শাক খেতে খুব সুস্বাদু।


কচুর পুষ্টিগুণ

কচুর শিকড় হল একটি সবজি যা সারা বিশ্বের বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহৃত হয়। এটির একটি হালকা, বাদামের স্বাদ, স্টার্চি টেক্সচার এবং পুষ্টির সুবিধা রয়েছে যা এটিকে আলুর মতো অন্যান্য মূল শাকসবজির একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প করে তোলে।কচু পুষ্টিতে সমৃদ্ধ যা গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান করতে পারে। এক কাপ পরিবেশনে আপনার প্রতিদিনের প্রস্তাবিত ম্যাঙ্গানিজ গ্রহণের এক তৃতীয়াংশ থাকে, যা ভালো বিপাক, হাড়ের স্বাস্থ্য এবং রক্ত জমাট বাঁধতে অবদান রাখে। এর উচ্চ মাত্রার ভিটামিন স্বাস্থ্যকর দৃষ্টি, ত্বক, সঞ্চালন এবং ইমিউন সিস্টেম ফাংশনকেও উন্নীত করতে পারে।

আঁশ

কচু মূলে আলুর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ফাইবার রয়েছে। খাদ্যতালিকাগত ফাইবার হজমের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, পেটের আলসার এবং অ্যাসিড রিফ্লাক্সের মতো সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি দিতে পারে। যেহেতু ফাইবার পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে ধীরে ধীরে চলে, গবেষণায় দেখায় যে এটি আপনাকে খাবারের মধ্যে পূর্ণতা বোধ করে, স্বাস্থ্যকর ওজন ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে

শর্করা

মুলে কার্বোহাইড্রেট উপাদান যাকে প্রতিরোধী স্টার্চ বলা হয়। এই ভাল কার্বোহাইড্রেটগুলি রক্তে শর্করাকে স্থিতিশীল করতে ক্লিনিকাল গবেষণায় দেখানো হয়েছে, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে পারে। এই স্টার্চগুলি কম কার্ব এবং কেটো ডায়েটের জন্যও উপযুক্ত।

হার্টের স্বাস্থ্য

শিকড়ে রয়েছে উচ্চ মাত্রার পটাসিয়াম, একটি খনিজ যা অতিরিক্ত লবণ ভেঙে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি আপনার কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমের উপর চাপ কমায়, দীর্ঘস্থায়ী হৃদরোগের বিকাশ রোধ করতে সাহায্য করে।

ক্যান্সারের সাথে যুক্ত ঝুঁকি কমায়

মূল ও এর ভোজ্য পাতা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। Quercetin, যা উদ্ভিজ্জের বেগুনি রঙ্গক থেকে আসে, একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আপনার শরীরকে মুক্ত র‌্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। ফ্রি র্যাডিকেলগুলি হল অণু যা আপনার শরীরে বার্ধক্য এবং জীবনযাত্রার কারণে তৈরি করে এবং কোষের ক্ষতি করে যা বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে ক্যান্সার হতে পারে।

পুষ্টি

কচু খাদ্যতালিকাগত ফাইবার এবং ভাল কার্বোহাইড্রেটের একটি চমৎকার উৎস, যা উভয়ই আপনার পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন হ্রাসে অবদান রাখতে পারে। এর উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি, ভিটামিন বি 6 এবং ভিটামিন ই একটি স্বাস্থ্যকর ইমিউন সিস্টেম বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং মুক্ত র্যাডিকেলগুলি দূর করতে পারে। মুলে উচ্চ মাত্রারও রয়েছে:
  • ম্যাঙ্গানিজ
  • পটাসিয়াম
  • তামা
  • ফসফরাস
  • ফোলেট
  • প্রতি পরিবেশন পুষ্টি

    এক কাপ মূলে রয়েছে:
  • ক্যালোরি: ১৮৭
  • প্রোটিন: ১ গ্রাম
  • চর্বি: ০.১ গ্রাম
  • কার্বোহাইড্রেট: ৩৯ গ্রাম
  • ফাইবার: ৭ গ্রাম
  • চিনি: ১ গ্রাম
  • মন্তব্যসমূহ