অন্যান্য প্রাণীর জীবনে খাদ্য জমিয়ে পরবর্তীকালে ভোগ করার প্রবণতা দেখা যায় না, কিন্তু মানুষের জীবনে খাদ্য বা সম্পদ পরবর্তী সময়ে ভোগ করার প্রবণতা দেখা যায় কেন?

খাদ্য সংরক্ষণ

মানুষ কেন খাদ্য সংরক্ষণ করে?
# খাদ্য সংরক্ষণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল খাদ্য নষ্ট হওয়া রোধ করা যতক্ষণ না এটি খাওয়া যায়। বাগানগুলি প্রায়শই এক সময়ে খুব বেশি খাবার উৎপাদন করে - নষ্ট হওয়ার আগে খাওয়ার চেয়ে অতিরিক্ত খাদ্য সংরক্ষণ করা সারা বছর ধরে বিভিন্ন ধরণের খাবারের সুযোগ দেয়।

আমাদের দেহটাকে একটি ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ইঞ্জিন জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করে। সেই শক্তি দিয়েই চলে। আমাদের দেহের সব ধরনের কাজের জন্যই শক্তি দরকার হয়, আর এ শক্তি আসে আমাদের খাওয়া খাদ্য থেকে।
আমাদের দেহের সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেসব উপাদান দ্বারা গঠিত, ওই উপাদানগুলো প্রতিনিয়িত কিছু না কিছু পরিবর্তিত হয়। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে- হাড়ে যে ক্যালসিয়াম আছে তা থেকে প্রতিদিন ৭০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম বের হয়ে আসে এবং খাবার থেকে ঐ ক্যালসিয়াম হাড়ে যায়। এভাবে অন্যান্য অনেক উপাদান দেহ থেকে বেরিয়ে যায় এবং খাবার থেকে ওইসব উপাদান এসে সে স্থান দখল করে। তাহলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, খাবারের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যাবতীয় কাজকর্মের জন্যই খাদ্য প্রয়োজন।

প্রাণীদের খাবারের প্রথম অংশ মস্তিস্ক নেয়। শেষ অংশ হাড়। আপনার হাড়গুলি কেবল আপনার শেষ খাবার দিয়ে তৈরি নয়, তবে আপনি যে খাবারগুলি বহু বছর ধরে খেয়েছেন তা সঞ্চিত হয়েছে তা দিয়েই তৈরি। সেই দাঁতগুলির গঠন দেখে গবেষকরা বলতে পারেন যে কিছু খাদ্যের একটি বড় উপাদান ছিল। এটি আমাদের অনেক কিছু বলে যে কিভাবে হোমিনিনরা বাস করত এবং তারা কী খেয়েছিল।

কার্বন সূত্র। C3 বা C4 উদ্ভিদ।

কার্বনের দুটি স্থিতিশীল আইসোটোপ রয়েছে: কার্বন -12 এবং কার্বন -13। পৃথিবীতে পাওয়া কার্বনের বেশিরভাগই কার্বন -12, যার মানে এতে ছয়টি প্রোটন এবং ছয়টি ইলেকট্রন রয়েছে, এর নাম ভ্যানিল্লা কার্বন ,। কার্বন -13, যা পৃথিবীর কার্বনের মাত্র 1.1% তৈরি করে, এতে ছয়টি প্রোটন এবং সাতটি নিউট্রন রয়েছে। এই কার্বনকে দারুচিনি কার্বন বলে।

গবেষকরা প্রায়শই কার্বনের রাসায়নিক স্বাক্ষর বিশ্লেষণ করেন যখন তারা জীব, জীবিত এবং মৃত অধ্যয়ন করেন, যেহেতু কার্বন জীবনের অণুর একটি মূল উপাদান। তেজস্ক্রিয় আইসোটোপগুলির বিপরীতে, স্থিতিশীল আইসোটোপগুলি তেজস্ক্রিয়ভাবে ক্ষয় হয় না, যার অর্থ তাদের অনুপাত সময়ের সাথে স্থির থাকে।

আদিম মানুষের চূড়ান্ত শক্তির উৎস ছিল C3 বা C4 উদ্ভিদ থেকে। C4 উদ্ভিদে তাদের সমকক্ষের চেয়ে বেশি কার্বন-13 থাকে এবং যারা এগুলো খায় তাদের হাড়ের মধ্যে এটি একত্রিত হয়। কার্বন-13 সরাসরি পাওয়া যেতে পারে, বা C4 উদ্ভিদে খাওয়া প্রাণীদের খাওয়ার মাধ্যমে।

মহান শস্য

মূলত সমস্ত মহান বনমানুষ এবং তাদের পূর্বপুরুষরা একটি C3-ভিত্তিক খাদ্য খেয়েছিল, ফল, পাতা এবং অন্যান্য গাছপালা খেয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। অন্যদিকে, আধুনিক মানুষ C4 উদ্ভিদের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে, যার মধ্যে রয়েছে গম এবং ভুট্টার মতো শস্য।

মানুষের জীবনে খাদ্য বা সম্পদ পরবর্তী সময়ে ভোগ করার যে প্রবণতা দেখা যায় সেটা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি । এর প্রধান কারণ মানুষের মস্তিষ্ক । বিবর্তনের কারনে আমাদের মস্তিষ্কের যে স্ফীতি ঘটেছে অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে তেমনটি কম হয়েছে । মানুষের মস্তিষ্ক তার দেহের তুলনায় বেশ বড় ।

ষাট কেজি ওজনের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্কের আয়তন যেখানে গড়ে ২০০ ঘন সেন্টিমিটার, সেখানে দুই মিলিয়ন বছর আগের আদি মানুষের মস্তিষ্কের গড় আয়তন ছিল ৬০০ ঘন সেন্টিমিটার আর আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক গড়ে ১২০০-১৪০০ ঘন সেন্টিমিটার।

চিত্র, বামে মানুষের ও ডানে গরিলার মস্তিষ্ক। মানুষের চেয়ে ওজনে তিনচার গুন বেশি হয়েও তার মগজ মানুষেরটার চেয়ে ক্ষুদ্র।

অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে প্রায় চারপাঁচ গুন বড় আমাদের মস্তিষ্ক । এত বৃহৎ মস্তিষ্ক চালানোর জন্য আমাদের প্রচুর রেডিমেড খাদ্যের প্রয়োজন হয় ।


বিশ্রাম কালেও মানব মস্তিষ্ক তার দেহের ২৫ শতাংশ শক্তি ব্যয় করে। ছোট মস্তিষ্কের জন্য সেখানে শিম্পাঞ্জি বা এপ দের ৮ শতাংশ শক্তি ব্যয় হয় । মানুষের পেশীর আয়তন ও শক্তি সময়ে কমে এসেছে । মানুষ পেশি বিসর্জন দিয়ে নিউরন বাড়িয়েছে ।

মস্তিষ্কের কোষ বা নিউরন, শক্তির জন্য স্বাভাবিক পরিবেশে গ্লুকোজের ওপর নির্ভরশীল , রক্তের মাধ্যমে মস্তিষ্কে সেই গ্লুকোজ পৌঁছে যায় আমাদের খাদ্য থেকে ।

ক্ষুধা লাগলে অন্য প্রাণীরা যেমন শিকারে যায় , আদিম মানুষকেও তেমনি শিকারে যেতে হতো । অন্য শ্বাপদ প্রাণীদের তুলনায় শিকার পেতে মানুষ কে খুব বেগ পেতে হতো । অনেক সময় সে নিজেই অন্যদের শিকারে পরিণত হত ।

প্রকৃতি বিরূপ হলে ফল মূল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হতো । তখন থেকে মানুষ খাদ্য জমিয়ে পরবর্তীকালে দ্রুত বর্ধনশীল মস্তিষ্কের চাহিদা কীভাবে পূরণ করা যায় , সে উপায়গুলো ভাবতে থাকে । এভাবেই মানব মস্তিষ্ক উদ্ভাবন করেছে মাংস আগুনে পুড়িয়ে বা সেদ্ধ করে রাখার বুদ্ধি , যাতে কাঁচা মাংস দ্রুত পচন ঠেকানো যায় । সর্বশেষ খাদ্য সংরক্ষণ করার জন্য ফ্রিজ আবিষ্কার করে সে। কারণ সে দেখেছে শীতকালে খাবার খুব কম পঁচে। ব্যাগ নিয়ে বাজারে হতে খাদ্য কিনে আনতে যে শক্তি ব্যয় হবে , তার চেয়ে কম সময়ে মস্তিষ্কের শক্তি যোগাবে ফ্রিজের সংরক্ষিত খাদ্য।

মানুষের মতো আরো কিছু বুদ্ধিমান প্রাণী পিঁপড়ে, মৌমাছি খাদ্য সংরক্ষণ শিখে গেছে বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকতে। এদের পিপে আছে, যেখানে প্রহরী থাকে খাবার পাহারা দিতে।

এখন প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাই । মানুষের বৃহৎ মস্তিষ্ক ই তাকে বাধ্য করেছে ভবিষ্যতে খাদ্য জমিয়ে ব্যবহার করার প্রবণতা ।

যে সকল নেতারা গরিব মানুষের ত্রান না দিয়ে নিজেরা লুকিয়ে রেখেছে , তাদের মস্তিষ্ক এখনো আদিম স্তরে রয়ে গেছে। সভ্যতার স্পর্শে পরিশীলিত হয়নি । ভালো মন্দের বোধ থেকে প্রবৃত্তির ই জয় হয়েছে সেখানে ।

সূত্র, নেচার সাইন্স।




খাদ্য সংযোজন কি




খাদ্য সংরক্ষণ কি


সাবস্ক্রাইব করুন। স্বাস্থ্যের কথা।

মন্তব্যসমূহ