আমরা জেনেছি, সেরোটোনিন, যা ৫-হাইড্রোক্সিট্রিপটামিন (৫-এইচটি) নামেও পরিচিত, একটি রাসায়নিক বার্তাবাহক যা শরীরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, একটি নিউরোট্রান্সমিটার এবং একটি হরমোন উভয়ই হিসেবে কাজ করে। এটি মেজাজ, হজম, ঘুম এবং রক্ত জমাট বাঁধার মতো বিস্তৃত কাজে জড়িত। কম সেরোটোনিনের মাত্রা হতাশা এবং উদ্বেগ সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে যুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে।
এটি মস্তিষ্কের স্নায়ুকে সংযোগকারী একটি নিউরোট্রান্সমিটার। রক্তনালিকায় রক্ত প্রবাহে এটি সাহায্য করে। এটি মানুষকে ভাল থাকার অনুভূতি প্রদান করে| তাই একে অনেক সময় সুখানুভূতির হরমোন বলা হয়। সেরোটোনিন স্বাভাবিক পরিমাণে থাকলে মানসিক সুখানুভূতির একটি ভারসাম্য অবস্থায় থাকে। আর তাই একে হ্যাপি কেমিকেলও বলা হয় কখনো।
সেরোটোনিন এবং স্বাস্থ্যগত অবস্থা:
- বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগ: নিম্ন সেরোটোনিনের মাত্রা এই অবস্থার সাথে যুক্ত।
- মাইগ্রেন: সেরোটোনিন রক্তনালী সংকোচনে ভূমিকা পালন করে এবং মাইগ্রেনের ট্রিগারে জড়িত।
- অন্যান্য অবস্থা: সেরোটোনিনের অনিয়ম হজমের সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত এবং এমনকি কিছু অটোইমিউন ব্যাধি সহ বিভিন্ন অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার সাথে যুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে।

টেস্টোস্টেরন এবং ইস্ট্রোজেন বাড়ায় লালসা; ডোপামিন, নোরপাইনফ্রাইন এবং সেরোটোনিন আকর্ষণ তৈরি করে; এবং অক্সিটোসিন ও ভাসোপ্রেসিন পরস্পর সংযুক্তি সৃষ্টি করে।
দেহে সেরোটোনিন কমে যাবার প্রভাব ও লক্ষণসমূহ:

সেরোটোনিনের নিম্ন মাত্রা হতাশা, উদ্বেগ এবং অবসেসিভ-বাধ্যতামূলক ব্যাধি সহ বিভিন্ন আচরণগত এবং মানসিক ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে।
আসলে, অনেক জনপ্রিয় অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট মস্তিষ্কের সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়ায়।
- পরিপাক ক্ষমতা কমে যায়, কারণ সেরোটোনিনের প্রধান কাজ সমূহের একটি হচ্ছে পরিপাকে সাহায্য করা। এতে করে ডায়রিয়া, কোষ্টকাঠিন্য , পেটে ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে।
- স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের প্রভাবে সেরোটোনিনের পরিমাণ কমে যায়। তখন মানসিক অবসাদ, বিষন্নতা ইত্যাদি দেখা যায়।
- তাই ডিপ্রেসিভ রোগীদের কিংবা Mood disorderএর রোগীদের চিকিৎসায় SSRI দেওয়া হয়, যা Circulatory সেরোটোনিনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
- ডিপ্রেশনের সময় যেহেতু সেরোটোনিনের পরিমান কমে যায়, তাই তাদের Associate symptoms হিসাবে Anorexia, Diarrhoea, constipation দেখা দেয়।
- ইনসমনিয়া ডেভেলপ করে, আর সকাল বেলায় জাগ্রত হতে সমস্যা হয়। ডিপ্রেশনের পেশেন্ট দের যেহেতু সেরোটোনিন এর পরিমাণ কম থাকে, তাই তাদের রাত্রে ঘুম হয় না, ইনসমনিয়া থাকে, আর সকাল বেলায় ঘুম বেড়ে যায়।
- দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সিন্ড্রোম (চরম, দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তি),
- ফাইব্রোমায়ালজিয়া (ব্যাপক ব্যথার অবস্থা),
- আলঝেইমারস, (প্রগতিশীল রোগ যা স্মৃতিতে সমস্যা এবং মানসিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে),
- পারকিনসন (স্নায়বিক রোগ যা আন্দোলনকে প্রভাবিত করে)
সেরোটোনিন বৃদ্ধিকারী প্রাকৃতিক খাদ্যসমূহ:

ট্রিপটোফেন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পাশাপাশি ব্যায়াম, হালকা থেরাপি এবং উচ্চ ফাইবার ডায়েট হল আপনার সেরোটোনিনের মাত্রা এবং সামগ্রিক মেজাজকে স্বাভাবিকভাবে উন্নত করার সবথেকে ভালো উপায়।
প্রোবায়োটিক সম্পূরকগুলিও সাহায্য করতে পারে। উপরন্তু, যোগব্যায়াম বা মননশীলতার মতো ক্রিয়াকলাপে নিযুক্ত থাকা মানসিক স্বাস্থ্যের সুবিধা প্রদান করতে পারে।
এটি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড ট্রিপটোফ্যান থেকে তৈরি, যা মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য এবং বাদামের মতো খাদ্য উৎস থেকে পাওয়া যায়।
অত্যাবশ্যকীয় অ্যামিনো অ্যাসিড ট্রিপটোফ্যান সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ভালো, যা রক্ত-মস্তিষ্কের বাধা অতিক্রম করতে পারে।

স্যালমন মাছ হল সর্বোচ্চ সেরোটোনিন উৎস,
- প্রাণীর প্রোটিন, যেমন টার্কি, মুরগি, মাছ
- ডিম
- দুধ
- সয়া পণ্য যেমন সয়াবিন (edamame), tofu, Seitan, সয়া দুধ
- চিনাবাদাম, সূর্যমুখী বীজ, কুমড়োর বীজ এবং তিল সহ বাদাম এবং বীজ
সেরোটোনিন উদ্দীপক ঔষধ
সেরোটোনিন বিভিন্ন শ্রেণীর অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট দ্বারা লক্ষ্যবস্তু করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SSRIs) এবং সেরোটোনিন-নোরপাইনফ্রাইন রিআপটেক ইনহিবিটর (SNRIs), যা সিনাপসে পুনঃশোষণকে বাধা দেয় এবং এর মাত্রা বাড়ায়।
এটি পোকামাকড় এবং কৃমি সহ প্রায় সমস্ত দ্বিপাক্ষিক প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায় এবং ছত্রাক এবং উদ্ভিদেও পাওয়া যায়। উদ্ভিদ এবং পোকামাকড়ের বিষে, এটি ব্যথা প্ররোচিত করে একটি প্রতিরক্ষামূলক কাজ করে।
রোগজীবাণু অ্যামিবা দ্বারা নিঃসৃত সেরোটোনিন মানুষের অন্ত্রে ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে, যদিও বীজ এবং ফলের মধ্যে এর উপস্থিতি হজমকে উদ্দীপিত করে এবং বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার সুবিধা প্রদান করে বলে মনে করা হয়।
ফার্মাকোলজি
কয়েক শ্রেণীর ওষুধ সেরোটোনিন সিস্টেমকে লক্ষ্য করে, যার মধ্যে রয়েছে কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যানসিওলাইটিক্স, অ্যান্টিসাইকোটিকস, ব্যথানাশক, মাইগ্রেন প্রতিরোধী ওষুধ, অ্যান্টিমেটিকস, ক্ষুধা নিবারক এবং অ্যান্টিকনভালসেন্ট, সেইসাথে সাইকেডেলিক্স এবং এনট্যাক্টোজেন।
সেরোটোনিন বৃদ্ধির ড্রাগসমূহ:
- Citalopram, সিটালোপ্রাম (আর্পোল্যাক্স 10,20 mg,সিপ্রামিল, সিটাপ্রাম)
- Escitalopram, এসকিটালোপ্রাম (সীটালাম, সিটালেক্স 5,10mg),,
- Fluoxetine, ফ্লুক্সেটিন (মোডিপ্রান, প্রোলার্ট, নোডেপ 20mg, প্রোজ্যাক বা অক্সাক্টিন)
- Fluvoxamine, ফ্লুভোক্সামাইন (ভক্সামিন 50,100,150 mg xr, ফেভারিন)
- Paroxetine, প্যারোক্সেটিন (অক্সাট 10, 20mg, পেরোটিন,সেরক্স্যাট)
- Sertraline, সারট্রালাইন (এন্ডেপ, চিয়ার, 50, 100 mg, লস্ট্রাল)
- Vilazodone
- ভোর্টিঅক্সেটিন (নাইটেনসো 10, 20 mg, ভিনটিল্যাক্স, Brintelix)
সেরোটোনিন লেভেল কমে গেলে SSRI drugs দেওয়া হয়, তবে SSRI এর কারণে সেরোটোনিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যেতে পারে, তখন আবার সেরোটোনিন সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। তাই SSRI প্রেসক্রাইব করার সময় রোগীর অবস্থা দেখে নিতে হবে। সেরোটোনিন সিন্ড্রোম এর কারণে সেক্সুয়াল ডিসফাংশন দেখা দেয়। তাই সবসময় ডিপ্রেশন আর সেরোটোনিন এর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য টেনশন মুক্ত থাকবে, আর সেরোটোনিন সম্পৃক্ত খাবার তথা যেসব খাবার খেলে প্রাকৃতিকভাবে সেরোটোনিন উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, তা বেশি করে খাওয়া উচিৎ।
ঔষধের মাত্রা ও সময়কাল
রুগী সনাক্ত হলে কোন রেজিষ্টার্ড ডাক্তার সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহের জন্য দিয়ে থাকেন। কিছু প্রতিক্রিয়া হতে পারে। কাঞ্জিত ফলাফল অর্জনের জন্য ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। যদি ফলাফল ও রুগীর আচরণ অনুকূল হয় তবে কমপক্ষে ৬ মাস ঔষধ চালাতে হবে।
কিছু রক্ত পরীক্ষা করে ঔষধের মাত্রা ও প্রতিক্রিয়া দেখা হয়। এরপর ঔষধের মাত্রা কমিয়ে এনে একসময় বন্ধ করা হয়। কিন্তু এসময় যদি রুগীর পূর্বোক্ত লক্ষণসমূহ রিল্যাপ্স করে তবে মাত্রা বাড়িয়ে আরো ছয়মাস প্রয়োজনে সারাজীবনও খেতে হতে পারে।
এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলোর সাথে সামঞ্জস্য করে মাত্রা নির্ধারণ ও সহযোগী ঔষধের প্ৰয়োজন হতে পারে।পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলো উত্তেজনা, ক্লান্তিচোখ, ঝাপসা লাগা, যৌনতা কমে যাওয়া, ক্লিনিকেলি শেষেরটি দিয়ে রুগীর উপর ঔষধের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করি আমরা। অতঃপর ব্যবস্থা নিই।
ঔষধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও ইফেক্ট এর ভারসাম্য রাখতে পারলে প্রয়োজন অনুযায়ী সারাজীবনও খাওয়া যেতে পারে।
"স্বাস্থ্যের কথা " বাংলা ভাষায় অনলাইন স্বাস্থ্য ম্যাগাজিন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বিশেষজ্ঞ মানবিক চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত। নিম্নোক্ত নম্বরে বিকাশ এর মাধ্যমে দান করে চিকিৎসা গবেষণায় সহায়তা করুন; +৮৮০১৮১৩৬৮০৮৮৬।
মন্তব্যসমূহ