খেসারি ও অপ্রচলিত ডালগুলোর উপকারিতা

খেসারী ডাল, ল্যাথেরিজম

আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি, ডাল বলতে শিম বা শুঁটির শুকনো, ভোজ্য বীজকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি মটর শুঁটি একটি শিম, কিন্তু শুঁটির ভিতরের মটর হল ডাল। ডালের খাদ্যগুন ও পুষ্টি এবং গুরুত্ব নিয়ে অন্য পৃষ্ঠায় ব্যাপক আলোচনা করেছি।



আমরা এখানে অপ্রচলিত অথচ ভীষণ উপকারী কিছু ডাল নিয়ে আলোচনা করবো।

ফেলন ডাল (কালো চোখের মটর)


ফেলন বা কালো চোখের মটর নরম মটরশুটি যা ব্যবহারের আগে ভিজিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। এগুলি সাধারণত ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিভিন্ন তরকারির জন্য ব্যবহৃত হয় এবং সাদা ছোলার মতোই ব্যবহার করা যেতে পারে।

মাষকলাই ডাল


উচ্চ পুষ্টির মানের কারণে, বিশেষ করে বীজে, কালোমুগ ডাল মানুষ এবং প্রাণীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য/খাদ্য উৎস হিসেবে কাজ করেছে। মুগের বীজে প্রায় 20.97-31.32% প্রোটিন থাকে, যেখানে সয়া এবং কিডনি বিনে প্রোটিনের পরিমাণ যথাক্রমে 18-22% এবং 20-30% থাকে।¹

প্রধানত লিগুমিনসি গোত্রের গুল্ম প্রজাতি vigna mungo থেকেই এই শস্য পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে এই ডাল জাতীয় শস্যটি সবথেকে বেশি প্রচলিত এবং এই অঞ্চলেই এর ব্যবহারের আধিক্য দেখা যায়। এটি সবুজ সার, আচ্ছাদক শস্য এবং পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার্য।


আপনি যদি সেগুলিকে সিদ্ধ করেন এবং সামগ্রিকভাবে কম রক্ষণাবেক্ষণের করেন তবে সেগুলি ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হতে পারে। তারা তাদের নরম প্রকৃতির কারণে তরকারি খাবারে পুরোপুরি মিশে যায়।

মাষকলাই ডালের পুষ্টি ;

মাষকলাই ডাল প্রচুর পুষ্টি গুণ সম্পন্ন ডাল।এর প্রতি ১০০ গ্রামে আছেঃ

  • ক্যালরিঃ ৩৪১
  • পটাসিয়ামঃ ৯৮৩ মি. গ্রা.
  • প্রোটিনঃ ২৫ গ্রাম
  • সোডিয়ামঃ ৩৮ মি.গ্রা.
  • কেলসিয়ামঃ ১৩৮ মি. গ্রা.
  • আয়রনঃ ৭.৫৭ মি. গ্রা.


মুগ স্প্রাউটে অতিরিক্ত প্রোটিন থাকে: স্প্রাউট প্রোটিনের প্রাপ্যতা বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, অঙ্কুরিত হওয়ার সময়, মুগের প্রোটিনের পরিমাণ 30% বৃদ্ধি পায়, অর্থাৎ, 100 গ্রাম অবিকৃত মুগে 24.9 গ্রাম প্রোটিন থাকে, কিন্তু অঙ্কুরিত হলে তা 32 গ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।

উরর / ওরোহের ডাল (কালো মসুর ডাল)


ডাল ভালো করে ধুয়ে, ৫ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে, রান্নার কাজে নিতে হবে।

উরর ডাল বা কালো ছোলার ডালের আকার প্রায় মুগ ডালের সমান। তারা প্রোটিন, চর্বি এবং কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ। কালো ছোলা মসুর ডাল ভারতে ব্যাপকভাবে পাপড় , পাতলা, খাস্তা ময়দা ভাজা বা শুকনো তাপে রান্না করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এগুলি ডাল মাখানি (মাখনের ডাল) এর একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদানও।

উরর ডালের পুষ্টি: ১০০ গ্রাম উরদ ডালের পুষ্টির মান নীচে দেওয়া হল:

  • শক্তি ৩৪৭ কিলোক্যালরি
  • প্রোটিন ২৪ গ্রাম
  • কার্বোহাইড্রেট ৫৯.৬ গ্রাম
  • মোট লিপিড ১.৪ গ্রাম
  • ক্যালসিয়াম ১৫৪ মিলিগ্রাম
  • আয়রন ৩.৮ মিলিগ্রাম

যখন পুরো ব্যবহার করা হয়, তখন উরড় ডালের স্প্লিট এবং চর্মযুক্ত জাতের চেয়ে স্পষ্টভাবে শক্তিশালী গন্ধ থাকে।

কালা চানা (কালো ছোলা)


কালো ছোলা শক্ত মসুর ডাল, তাই রান্না করতে একটু বেশি সময় লাগে। এই ক্ষেত্রে, ভেজানোর সুপারিশ করা হয়।

কালা চানা বা কালো ছোলা হল মসুর ডাল যা তরকারি, শুকনো খাবার, নিরামিষ কাবাব এবং বিভিন্ন চাট (রাস্তার খাবার) এর মধ্যে থাকে।

ছোলার মতো, কালা চানায় প্রোটিনের পরিমাণ বেশি, কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং এটি একটি হার্ট-স্বাস্থ্যকর বিকল্প।

প্রায়শই, দ্রুত ফলাফলের জন্য কালা চানা প্রেসার কুকার বা ইনস্ট্যান্ট পটে রান্না করা হয়।

মাটকি (তুর্কি/শিশির গ্রাম মটরশুটি)



তুর্কি/শিশির ছোলা শিম হল একটি মাটির শিম যা বাদামের স্বাদযুক্ত।

মথ বিন নামেও পরিচিত, এই মটরশুটি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন এবং খনিজগুলির একটি দুর্দান্ত উত্স। শুঁটি, স্প্রাউট এবং বীজ সাধারণত ভারত জুড়ে ব্যবহৃত হয় এবং রান্না বা ভাজা যায়।

এই ডাল দিয়ে তৈরি একটি জনপ্রিয় খাবারের নাম মাটকিচি উসল, এটি দিয়ে তৈরি একটি হৃদয়গ্রাহী তরকারি।

খেসারী ডাল

খেসারি ডালের বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাথেরাস স্যাটিভাস, যা ঘাসের মটর, সাদা মটর এবং সাদা ভেচ হিসাবে পরিচিত।

খরা এবং দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমন অঞ্চলে এটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ফসল, এবং অন্যান্য সমস্ত ফসল ব্যর্থ হলেও এটি নির্ভরযোগ্য ফলন দেয় বলে একটি 'বীমা ফসল' হিসাবে ভাবা হয় একে।

বাংলাদেশে পশুখাদ্য হিসেবে সাধারণত খেসারি চাষ হয়, তবে দেশের আমিষ খাদ্য হিসেবেও জনপ্রিয়।




বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল ছাড়াও ফ্রান্স , ইতালি, স্পেন ও অস্ট্রেলিয়াতেও এ ডালের প্রচলন রয়েছে। আলজেরিয়ায় এ ডালের প্রচলন সবচেয়ে বেশি। এই ডালে অ্যামাইনো এলাইনিক এসিড নামক উত্তেজক নিউরো টক্সিন রয়েছে। যা স্নায়ুবিক পঙ্গুতা বা প্যারালাইসিসের জন্য অনেকাংশই দায়ী। এ রোগকে ল্যাথারিজম বলা হয়।

শুধু মানুষেরই নয়, ঘোড়া ও গবাদি পশুকেও যদি দীর্ঘদিন ধরে এ ডাল খাওয়ানো হয় তাহলে এসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

১৯৭০ সালে ইথিওপিয়ার বন্যার অঞ্চলে মহামারী দেখা দিয়েছিল। এতে এক শতাংশ মানুষ স্থায়ী ভাবে পঙ্গু হয় ল্যথারিজমের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খেসারি একটি সাধারণ খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হত।

আর তখনই ল্যাথারিজিম মহামারী আকারে দেখা দেয়। আফগানিস্থানে দুর্বিক্ষের কারণে খাদ্য তালিকায় খেসারি আনা হয়েছে। যা যেকোনো মূহূর্তে ল্যাথাইরিজিমে আক্রান্ত করতে পারে। খেসারির ডাল খেলেই যে ল্যাথারিজম হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়।

খেসারির ডাল ও খাসারি থেকে তৈরি আটা দৈনিক খাদ্যে তালিকায় যদি এক তৃতিয়াংশ বা অর্ধাংশ থাকে আর এটা যদি টানা তিন থেকে ছয় মাস খাওয়া হয়, তবে ল্যাথাইরিজিম হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় ৮০ শতাংশ।

এ রোগে নারীদের থেকে পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে, যাদের বয়স মোটামুটি ২৫ থেকে ৪০ এর মধ্যে। অপরিপক্ব ও সেদ্ধ ডাল খেলে রিক্স হতে পারে, খেসারি গাছের অংশসহ রান্না করে খেলে রিক্স হতে পারে।



ল্যাথেরিজম কী

লাথিরিজম প্রাচীনতম পরিচিত নিউরোটক্সিক ব্যাধিগুলির মধ্যে একটি, ল্যাথেরিস স্যাটিভাসে অত্যধিক সেবনের ফলে হয় । লাথেরিজম বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত এবং ইথিওপিয়া অঞ্চলে তেমন নেই।

নিউরোফিজিওলজিক এবং নিউরোপ্যাথলজিক গবেষণাগুলি বলছে কর্টিকোস্পাইনাল ট্র্যাক্টের মাইলিন ক্ষয়প্রাপ্ত হয় প্রকাশ করেছে।

যে পদার্থ β-N-oxalyl-amino-l-alanine থেকে লাথেরিজমের হয়,তা নিউরোট্রান্সমিটার গ্লুটামেট বিরোধী।

এর বিষাক্ততার কারণে, ১৯৮৭ সাল থেকে এটি মানুষের ব্যবহারের জন্য স্পেনে নিষিদ্ধ। এটি পশুর খাদ্য হিসাবে বিক্রি করা যেতে পারে তবে এটি মানুষের ব্যবহারের জন্য বৈধ অন্য ফ্লোরগুলির কাছে প্রদর্শিত হতে পারে না।

ল্যাথাইরিজমের লক্ষণ:

ল্যাথাইরিজমের লক্ষণগুলো হঠাৎ করেই শুরু হয়।

প্রাথমিকভাবে হাঁটতে অসুবিধে হয়।

অসহ্য যন্ত্রণা হয়। পা অবশ হয়ে যায়।

এই ধরণের নানা রকম অনুভূতি দেখা দেয়।

ধীরে ধীরে মাংসপেশীর অসরতা দেখা দেয়। যা কোনো ভাবেই ঠিক হয় না।

এরপর শুরু হয় অঙ্গ সঞ্চালন অক্ষমতা। এর ফলে শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ কাঁপতে শুরু করে।

অঙ্গ প্রতঙ্গ নাড়া চাড়া করা যায় না। গিটে গিটে বা হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। এর ফলে পেশি শক্ত হয়ে যেতে পারে।

দু’ধরণের লেথারিজম দেখা যায়-

এনজিও লেথারিজম এবং অস্টিও লেথারিজম।

লেথারিজমে শুধু পঙ্গু হয়ে যায় তা কিন্তু নয়। অস্টিও লেথারিজমে দৈনিক কঙ্কাল সৃষ্টিতে বাঁধা গ্রস্থ করে থাকে। এর ফলে তরুনাস্থি অনিয়ন্ত্রত ভাবে বাড়তে থাকে। আর দেহ অদ্ভদ গঠনে রুপ নেয়।

বাচ্চারা এতে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্ক গঠন ও অঙ্গ গঠন বাঁধাগ্রস্থ হয়ে থাকে। লেথারিজম সাধারণত ভালো হয় না। তবে মাংসপেশী শিথিল করার মতো কিছু ওষুধ অসারতা কিছুটা কমাতে পারে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত এর জন্য তেমন কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ তৈরি হয় নি।

প্রতিকার:

লেথারিজম প্রতিকারের প্রধান উপায় হলো খেসারি ডাল না খাওয়া। আর যদি বন্যদুর্গত এলাকায় খেসারি ডাল খেতেই হয় তবে বার বার গরম পানি দিয়ে ধুঁয়ে বিষাক্তভাব কমিয়ে নিতে হবে।

এরপর এ ডাল রান্না করার আগে উচ্চ তাপমাত্রায় ভেজে নিতে হবে। তবে ৮০ শতাংশ বিষাক্তমুক্ত হয়ে যাবে। আর খেসারি ডাল রান্না করার আগের রাতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর ভেজানো পানি ফেলে রান্না করতে হবে। এভাবে রান্না করলে খেসারি ডাল ৯০ শতাংশ বিষমুক্ত হবে।

সূত্রঃ নেচার সায়েন্স, উইকিপিডিয়া
1-Mung bean proteins and peptides: nutritional, functional and bioactive ...

মন্তব্যসমূহ